মৌলিক গণতন্ত্র কি | মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ?
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে মৌলিক গণতন্ত্র কি | মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ? নিয়ে আলোচনা করব।
মৌলিক গণতন্ত্র হলো একটি সীমিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকারের পরিবর্তে কিছু নির্ধারিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। এই ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত থাকে। জনগণের ভোটাধিকার থাকলেও তা সরাসরি নয়, বরং পরোক্ষ।
অর্থাৎ, জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে, যারা পরবর্তীতে রাষ্ট্রের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই ব্যবস্থাটি মূলত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তন করেছিলেন। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মৌলিক গণতন্ত্রের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, স্তরবিন্যাস এবং এর ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মৌলিক গণতন্ত্রের পরিচয়
মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) হলো জেনারেল আইয়ুব খানের একটি অভিনব শাসন ব্যবস্থা। ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর, ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিনি মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি শাসন ব্যবস্থার আদেশ জারি করেন।
এই ব্যবস্থাটি ছিল চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামো, যা পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) প্রয়োগ করা হয়। আইয়ুব খান এই ব্যবস্থাকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেছিলেন, "It will be a foundation stone of a new political system in the country."
মৌলিক গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং সরকারী কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছাকাছি আনা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে, এই ব্যবস্থাটি মূলত একটি পরোক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল, যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত ছিল।
মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ছিলেন সার্বভৌম শাসক। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, আইনপ্রণেতা এবং বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছিল অপরিসীম।
২. পরোক্ষ নির্বাচন
এই ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারত না। তারা তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করত, যারা পরবর্তীতে রাষ্ট্রের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। এই প্রতিনিধিরা ইলেক্টোরাল কলেজ হিসেবে কাজ করতেন এবং রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনে ভোট দিতেন।
৩. গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসন
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসন হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ, এই ব্যবস্থায় জনগণের ভোটাধিকার ছিল সীমিত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। আইয়ুব খানের এই ব্যবস্থা সমালোচিত হয়েছিল, কারণ এতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ কম ছিল।
৪. স্থানীয় সরকার কাঠামো
মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এই স্তরগুলো হলো: ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল এবং বিভাগীয় কাউন্সিল। এই কাঠামোর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করা হতো।
মৌলিক গণতন্ত্রের স্তরসমূহ
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা চারটি স্তরে বিভক্ত ছিল। নিচে এই স্তরগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. ইউনিয়ন কাউন্সিল
ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন স্তর। ৫ থেকে ৮টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হতো, যার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ জন। পৌর এলাকায় এটিকে ইউনিয়ন কমিটি এবং ছোট শহরে টাউন কমিটি বলা হতো। একটি ইউনিয়ন কাউন্সিলে ১৫ জন সদস্য থাকতেন, যার মধ্যে ১০ জন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং বাকি ৫ জন মনোনীত হতেন। তবে ১৯৬২ সালে এই মনোনয়ন পদ্ধতি বাতিল করা হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন।
ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদেরকে বিচার বিভাগীয়, অর্থনৈতিক, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন উন্নয়নের মতো বিভিন্ন কার্যভার দেওয়া হয়। সবশেষে, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য এই ইউনিয়ন পরিষদকে ইলেক্টোরাল কলেজে রূপান্তর করা হয়।
২. থানা কাউন্সিল
থানা কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় স্তর। এই পরিষদে কোনো নির্বাচন হতো না। এটি কিছু অফিসিয়াল এবং কিছু বেসরকারী সদস্য নিয়ে গঠিত হতো। বেসরকারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং অফিসিয়াল সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার সকল সরকারি কর্মকর্তা। থানা কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক।
থানা কাউন্সিলের মূল কাজ ছিল থানার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
৩. জেলা কাউন্সিল
জেলা কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তর। এর সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৪০ জন, যার অর্ধেক সদস্য ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক নির্বাচিত প্রতিনিধি। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের থেকে নির্বাচিত হতেন।
জেলা কাউন্সিলের কার্যাবলীর মধ্যে ছিল জেলার উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করা, কর আরোপ করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পরিষেবা নিশ্চিত করা।
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল
বিভাগীয় কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তর। এটি ৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতো, যার অর্ধেক ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক ছিল জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিবর্গ। বিভাগীয় কমিশনার তার পদাধিকার বলে বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন।
বিভাগীয় কাউন্সিলের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন জেলা কাউন্সিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কাজ তদারকি করা।
উপসংহার
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের জনগণকে গণতন্ত্রের মূলনীতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আইয়ুব খান মনে করতেন, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পাকিস্তান ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবে, এই ব্যবস্থাটি তেমন সফল হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলি নিষিদ্ধ ছিল এবং সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা কঠিন ছিল। ফলে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিবর্তে, সরকারের প্রতি ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন হয় এবং মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
মৌলিক গণতন্ত্রের ইতিহাস আমাদেরকে শেখায় যে, প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। এই ব্যবস্থাটি যদিও একটি অভিনব প্রচেষ্টা ছিল, তবে এর সীমাবদ্ধতাগুলোই শেষ পর্যন্ত এর পতন ডেকে আনে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। মৌলিক গণতন্ত্র কি | মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ? এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url