ইউরোপীয় রেনেসাঁর ইতিবাচক প্রভাব

ইউরোপীয় রেনেসাঁর ইতিবাচক প্রভাব

ইউরোপীয় রেনেসাঁর ইতিবাচক প্রভাব 

ইটালি তথা ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই নবজাগৃতির কিছু ইতিবাচক দিক তথা প্রভাব ছিল লক্ষণীয়।

(1) মানসিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন

ইউরোপীয় নবজাগরণ মানুষের নৈতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত করেছিল। এই সময় মানুষের মনে চিরাচরিত খ্রিস্টীয় অনুশাসনের প্রতি সংশয় দেখা যায়। রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত ইতালীয় মানবতাবাদী সালুতাতি (Coluccio Salutati) ভক্তিবাদী খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী হলেও এমন এক নব্য জীবনদর্শনের কথা বলেন, যেখানে মানুষ একটি সুখী ও সফল জীবনযাপন করতে পারে। এই কালপর্ব থেকেই ঈশ্বরের শক্তি ও রহস্যের পরিবর্তে মানুষ তাদের প্রকৃতি, কৃতিত্ব ও সম্ভাবনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।

(2) স্বতন্ত্র সত্তার জ্ঞান

জার্মান পণ্ডিত ও দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (Friedrich Engels) নবজাগরণকে বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। যদিও অনেকেই এই মতের বিরোধিতা করেন। তবে বিতর্ক থাকলেও একথা ঠিক যে, নবজাগরণের কারণে মানুষ নিজেকে চিনতে শিখেছিল। ইরাসমাসের ভাষায়, দীর্ঘকালীন গভীর নিদ্রা থেকে মানুষ জেগে উঠেছিল। এই মননশীল আন্দোলনের ফলে এক নতুন জীবনদর্শন জন্ম নেয়, যার কেন্দ্রে ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা। এসময় ব্যক্তিজীবন (Private spheres of life) এবং গোষ্ঠীজীবন (Public spheres of life) -এর প্রভেদ সম্পর্কে মানুষের ধারণা পুষ্ট হয়েছিল। মানুষ বুঝতে শিখেছিল যে, কেবলমাত্র একজন যাজক, সামন্ত বা কৃষক নয়; সে একইসঙ্গে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। একজন কারিগর কেবল একটি গিল্ডের সদস্য নয়, একইসঙ্গে তার একটা পৃথক 'ব্যক্তি' (Person) অস্তিত্বও আছে। এইভাবে গড়ে উঠেছিল মানবতাবাদের চেতনা।

(3) ভাষা ও সাহিত্যচর্চা

রেনেসাঁর কালপর্বে ব্যাপকভাবে ধ্রুপদি যুগের ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি শুরু হয়েছিল ল্যাটিন ভাষাচর্চাও। এই সময় মানবতাবাদী পণ্ডিতেরা ল্যাটিন ভাষায় ব্যাকরণ, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি প্রকাশ করেন। এগুলি বহুকাল যাবৎ ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গীভূত ছিল। এ ছাড়া শুরু হয়েছিল স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চাও। পাশাপাশি সাহিত্য ছাড়া শিল্পের ক্ষেত্রেও অঞ্চল বা দেশভেদে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা হয়েছিল।

(4) শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় উন্নতি

নবজাগরণের ফলে ইউরোপে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আসে। আলোচ্য পর্বে ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার পরিবর্তে শুরু হয় মানবতাবাদী শিক্ষা। এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল 'পূর্ণ মানুষ তৈরি' (Development of allround man)। এই সময় থেকে উন্নত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চাও। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, কেপলারের প্রদত্ত সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা প্রথাগত চিন্তাভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস (Andreas Vesalius) শারীরতত্ত্ব এবং উইলিয়ম হার্ভে (William Harvey) রক্তসঞ্চালনের ধারণা দেন, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। পাশাপাশি মুদ্রণ ব্যবস্থায় বিপ্লবের ফলে প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে, যেগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

(5) শিল্পে যুগান্তর

রেনেসাঁ যুগে শিল্প-স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় যুগান্তর আসে। মধ্যযুগের শিল্পকলা ছিল ঈশ্বরকেন্দ্রিক। কিন্তু মানবতাবাদী শিল্পীরা মানুষ ও মানুষের জীবনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, দোনাতেল্লো প্রমুখের সৃষ্টিগুলি জীবন এবং জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে তুলে ধরে। এইসব শিল্পীদের কর্ম, চিন্তা ও দর্শন আধুনিক শিল্পকলার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

(6) ভাষাগত রাজ্যগঠন

নবজাগরণ আন্দোলনের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র পরিচয়ের (Seperate Identity) ধারণা জোরালো হয়। ইতিপূর্বে রোমান সাম্রাজ্যের পতাকাতলে বিভিন্ন অঞ্চল আংশিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ল্যাটিন সংস্কৃতি এবং খ্রিস্টান ধর্ম একধরনের সংহতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখন ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতেও নতুনভাবে রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সুতরাং এটা বলাই যায় যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সুপ্রভাবগুলি পরবর্তী যুগকেও প্রভাবিত করেছিল। এই নবজাগরণ একদিকে যেমন প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের শিক্ষা দিয়েছিল, তেমনই বিকাশ ঘটিয়েছিল যুক্তিবাদের। স্বীকৃত হয়েছিল মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url