সুনাগরিক বলতে কী বোঝ? একজন সুনাগরিকের গুণাবলি আলোচনা করো

সুনাগরিক বলতে কী বোঝ? একজন সুনাগরিকের গুণাবলি আলোচনা করো

সুনাগরিক

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উৎকর্ষ ও অগ্রগতি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিচারবুদ্ধি ও সচেতনতার ওপর। জনমতের ওপর নির্ভর করেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতি ও কার্যক্রম স্থির হয়। এই কারণে একটি ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দরকার উন্নত চেতনাসম্পন্ন নাগরিক, শৃঙ্খলাপূর্ণ মতামত, সদাজাগ্রত জনমত। যখন কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে এইসব গুণ দেখা যায় তখন তাকে বলা হয় সুনাগরিক।

ল্যাস্কির অভিমত

একজন সুনাগরিকের আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাঙ্কি বলেছেন-একজন সুনাগরিক কেবলমাত্ত নিজের কল্যাণের কথাই ভাবে না, একইসঙ্গো যে সমাজের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করে। তা ছাড়া প্রতিটি সুনাগরিকের বিচারবুদ্ধি থাকবে এবং সেই বিচারবুদ্ধি যথাযথ স্থানে প্রয়োগ করার ক্ষমতাও থাকবে।

লর্ড ব্রাইসের অভিমত

লর্ড ব্রাইস মনে করেন একজন সুনাগরিকের তিনটি গুণ থাকা অবশ্য প্রয়োজন। এগুলি হল- [1] বিচারবুদ্ধি, (2) আযানিয়ন্ত্রণ এবং [3] বিবেক।

বার্নসের অভিমত

বার্নস লর্ড ব্রাইসের এই তিনটি গুণ ছাড়াও আরও দুটি গ্রুপের কথা বলেছেন। এগুলি হল- (4) দেশপ্রেম এবং [5] স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি।

সুমাগরিকের গুণাবলি

অতএব বলা যায় যে, একজন সুনাগরিকের প্রধানত যে সমস্ত গুণগুলি থাকতে হবে-

(1) বিচারবুদ্ধি

একজন সুনাগরিককে শিক্ষিত ও যুক্তিনিষ্ঠ হতে হবে। সুনাগরিকের কাজ হল সরকার কর্তৃক গৃহীত আইন জনকল্যাণকে ব্যাহত করছে কি না তা খতিয়ে দেখা। নাগরিকের সচেতনতাই সরকারকে প্রগতিশীল কাজে উৎসাহিত করতে পারে এবং সরকারও সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারে।
 
চেতনাসম্পন্ন নাগরিক না হলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। চেতনাসম্পন্ন নাগরিক রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্যাগুলির স্বরূপ যেমন উপলব্ধি করতে পারে, তেমনই আবার সেইসব সমস্যার যথাযথ সমাধানও করতে পারে। নাগরিক চেতনাসম্পন্ন না হলে সমগ্র সমাজের কল্যাণ ব্যাহত হবে।

[2] সংযম

সুনাগরিকের একটি উল্লেখযোগ্য গুণ হল আত্মসংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ। কোনো সুনাগরিক সংকীর্ণ স্বার্থ-বুদ্ধি, সংস্কার বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করে না। সে ব্যক্তিস্বার্থ অপেক্ষা সমাজের সামগ্রিক স্বার্থের দিকেই সদাসর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখে।
 
কোনো সংকীর্ণ স্বার্থের সঙ্গে সর্বজনীন স্বার্থের বিরোধ দেখা দিলে সুনাগরিক সংকীর্ণ স্বার্থকেই বিসর্জন দেয় এবং সর্বজনীন স্বার্থকে রক্ষা করে। অর্থাৎ সচেতন নাগরিক সবসময় পরমতসহিন্তু হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মসংযমই মানুষকে পরমতসহিন্তু করে তোলে।

[3] বিবেক

সুনাগরিকের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তাকে বিবেকবোধসম্পন্ন হতে হবে। যে সমস্ত নাগরিক বিবেকবর্জিত তারা কখনোই নিজের বা সমাজের বা রাষ্ট্রের জন্য ভালো কিছু ভাবতে পারে না। বিবেকবোধহীন নাগরিক অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে পারে এবং এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধিত হতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
 
বিবেকবোধহীন নাগরিক সমাজের স্বার্থপর ও কুটিল মানুষের শিকার হয়ে পড়লে তাদের কাছ থেকে কোনোপ্রকার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের আশা করা যায় না। একজন বিবেকবোধসম্পন্ন নাগরিক যথাসময়ে কর প্রদান করে, বিচারবিবেচনা করে ভোট প্রদান করে, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করে।

[4] দেশপ্রেম

একজন সুনাগরিক অবশ্যই দেশপ্রেমী ও সুস্থ জাতীয়তাবোধসম্পন্ন হবে। নাগরিকের মধো দেশপ্রেম থাকলে দেশটি উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। কারণ দেশের স্বার্থে দেশপ্রেমীরা নিজেদের সবকিছু বলিদান করতে পারে। বিশেষ করে দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
 
নাগরিক ভালো না হলে তার দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রযুক্তি কোনো কিছুকেই সে রক্ষা করতে পারে না। সুনাগরিক তার জাতীয়তাবোধকে বিশ্বমানবতার আদর্শে উদ্ভাসিত করতে পারে, সে অন্যজাতিকে বা দেশকে কখনোই ঘৃণা করে না।

[5] স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি

স্বাধীন চেতনাসম্পন্ন মনোবৃত্তি সুনাগরিকতার একটি উল্লেখযোগ্য গুণ। দেশের নাগরিক যদি স্বাধীন চেতনাসম্পন্ন হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সরকার কখনোই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু জনগণ যদি স্বাধীনচেতনাসম্পন্ন না হয় তাহলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠে জনকল্যাণকে ব্যাহত করবে। এর ফলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটবে না এবং সারা দেশ সংকটে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

উপসংহার

সুনাগরিকতার গুণের ওপরই নির্ভর করে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য অথবা ব্যর্থতা। যে দেশের নাগরিকদের মধ্যে সদ্গুণ, সচেতনতা, বিবেকবোধ প্রভৃতির অনুপস্থিতি বিরাজ করে সেই দেশের সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে এবং গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
 

0/Post a Comment/Comments