সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো নিয়ে আলোচনা করব।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা বৈশিষ্ট্যসমূহ
অধ্যাপক অ্যালন বল, ফাইনার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সর্বাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি রূপ বলে মনে করেন। সর্বাত্মক রাজনৈতিক মতবাদ রাষ্ট্রের সার্বিক প্রাধান্যের কথা প্রচার করে; যেখানে বাস্তির জন্য রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের জনাই ব্যক্তি। অধ্যাপক কোকার বলেছেন যে, সর্বাত্মক রাষ্ট্র যে- কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনায় অধিক স্বৈরাচারমূলক রাষ্ট্র।
সর্বাত্মক রাষ্ট্র হল এমন একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা, যেখানে কোনোপ্রকার বিরোধিতা বা সমালোচনা সহ্য করা হয় না, যেখানে শিল্প-বাগিজা প্রভৃতি সকল বিষয়ই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং যে শাসনব্যবস্থায় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিস্ট বিরোধিতা প্রাধান্য পায়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চরম প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই সর্বাত্মক রাষ্ট্রবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
এই তত্ত্বটি যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্র-দার্শনিকদের হাত ধরে বিকশিত হয় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- জার্মান দার্শনিক স্ট্রিট্ঙ্কে, নিসে; ইতালির দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেজোলিনি, জিওভিন্নি, জেস্টাইল, গ্যাব্রিয়েল ডি অ্যানানজিও প্রমুখ।
রাষ্ট্র সম্পর্কিত এই মতবাদ রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন (totalitarian) বৈশিষ্ট্যটিকে তুলে ধরতে চায়। এই মতাদর্শ অনুসারে সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানকল্পে যে সংহতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়, সেখানে অন্য কোনো মতের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়। অর্থাৎ, সর্বাত্মক মতই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত বলে এই মতবাদ মনে করে।
তাঁরা চেয়েছে দেশের সবরকম পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সবই হবে ফ্যাসিস্ট মতানুসারে। এই কারণে তাঁদের কাছে যা প্রতিষ্ঠা করা চিন্তার বাইরে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলপ্রয়োগেও তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না। দ্বিতীয় কোনো মতপ্রকাশের এখানে কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিপুল জনসমর্থন আদায়ের ফলস্বরূপ সর্বাত্মকবাদের আবির্ভাব ঘটে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিবৈষম্য, ইহ্রদি বিদ্বেষ, বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রভৃতি সর্বাত্মকবাদ উদ্ভবের সময় বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল।
তা ছাড়া তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্রদ্র্য, পুঁজিবাদী অর্থনীতির নগ্ন প্রতিযোগিতা, পুঁজিতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রভৃতি মিলিয়ে ইউরোপ তথা ইতালি ও জার্মানিতে মানুষের মধ্যে এক বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মকবাদ।
সর্বাত্মকবাদ মনে করে, সব কিছুই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক- তাই রাষ্ট্র-বহির্ভূত কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। এখানে হেগেলীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কারণ রাষ্ট্রকে হেগেল এমন একটি স্বাধীন সত্তা বলেছেন, যার আছে 'real wil' বা 'প্রকৃত ইচ্ছা', যা গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে প্রকাশ করে না। সর্বাত্মকবাদ রাষ্ট্রনৈতিক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে।
এই ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের কথা বলা হয়। সর্বায্যকবাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সর্বায্যকবাদ চায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের দ্বারা নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সীমাবদ্ধ করতে।
এই মতবাদ অনুসারে কোনো রাষ্ট্রে সর্বাত্মকবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম পদ্ধতি হল হিংসার আশ্রয়গ্রহণ। সর্বাত্মকবাদের ক্ষেত্রে তাঁদের মতাদর্শের বিরোধী ব্যক্তিদের উচ্ছেদ-তাঁদের একটি ঘোষিত নীতি। সর্বক্ষমতা- সম্পন্ন রাষ্ট্রসৃষ্টির অনতাম উদ্দেশ্য হল হিংসা প্রকাশের সুযোগ। সর্বাত্মক মতবাদ যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে, তা হল নৈতিক ও আদর্শগত বা ভাবগত অস্তিত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রে নারীস্বাধীনতা সংকুচিত। হিটলার মনে করেন, নারীদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল জার্মান যোদ্ধার জন্মদান। তাই, তিনি নারীদের অর্থনৈতিক কাজ থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দি করে রাখার কথা বলেন। অর্থাৎ নারীস্বাধীনতায় সর্বাত্মকবাদের আস্থা ছিল না; বরং নারীজাতির প্রতি সর্বাত্মকবাদ অনাস্থা প্রকাশ করেছিল।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা তার প্রচারকার্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ (recism)-কে কাজে লাগিয়ে ঘৃণা, সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার সৃষ্টি করে। এর মধ্য দিয়ে উদারনীতিবাদ, প্রগতিবাদ, মুক্ত অর্থনীতি প্রভৃতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
ট্রিঙ্কে রাষ্ট্রকে 'শক্তির প্রতীক' বলেছেন। অর্থাৎ, এই মতবাদ ক্ষমতাকে পূজ্য বিষয় বলে মনে করে। এই
মতানুসারে ক্ষুদ্র বা ছোটো রাষ্ট্র হল পাপের প্রতীক। তাই রাষ্ট্র বিস্তারের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে যুদ্ধ কোনো অন্যায় কাজ হিসেবে গণ্য হয় না।
সর্বোপরি, সর্বাত্মক মতবাদ গণতন্ত্রের কথা বললেও তা ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে জনসাধারণের আনুগত্য প্রার্থনা করে এবং তাদের ওপর বিপ্লবী পন্থায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিস্থাপনে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url