রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যাখ্যা করো

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যাখ্যা করো নিয়ে আলোচনা করব।

রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যাখ্যা করো

রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি

নারীবাদের প্রবক্তাগণ একটি সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিকে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পূর্বে প্রচলিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
 
কোনো কোনো রাষ্ট্রতাত্ত্বিক প্রচলিত তত্ত্বগুলিতে নানা বিচ্যুতি ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, অধিকার, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতিকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে না দেখে রাজনৈতিক তত্বে পুরুষতান্ত্রিক বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
 
রাজনীতির সকল বিষয় পুরুষতান্ত্রিক ভাষা প্রয়োগ করেই তাকে বিশ্লেষণ করা হয় বলে নতুন তাত্ত্বিকরা মনে করেন পুরুষতান্ত্রিক বিষয়গুলিকে রাজনীতির মধ্যে ব্যবহারের পক্ষপাতিত্বের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে।
 
তাঁরা মনে করেন, সাবেকি ও আধুনিক উভয় ধরনের আলোচনার মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেক তাত্ত্বিক প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ও আধিপত্যবাদী চিন্তাধারা এবং বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক আলোচনার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহী, সংস্কারবাদী ও সমালোচনামূলক প্রচার শুরু হয় তা নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নামে পরিচিত।
 
নারীবাদ সাবেকি ও আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার পুনর্মূল্যায়ন করতে চেয়েছে। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে নস্যাৎ করে রাজনীতি ও সমাজকে নতুনভাবে দেখার কতকগুলি প্রবণতা গড়ে তোলে। তাদের চিন্তাধারার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

প্রথমত,
নারীবাদ হল এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা লিঙ্গা কর্তৃত্ব বা লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান চায়।

দ্বিতীয়ত, নারীবাদ চায় সমাজে লিঙ্গগত বৈষম্য দূর করে এমন এক সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করতে যেখানে নারীরা ভোগ করবে সমান অধিকার এবং সমান সুযোগসুবিধা।

তৃতীয়ত,
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মূলত একটি প্রতিবাদী আন্দোলন। নারী সম্পর্কিত প্রচলিত ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি-যা নারীকে হীন করে ও লাঞ্ছনা দেয়, এই আন্দোলন সেগুলিকে বর্জন করার কথা বলে। নারী যেখানে বর্জিত ও উপেক্ষিত সেইসব বিষয়গুলিকেও বর্জন করার জন্য এই আন্দোলন সোচ্চার।

চতুর্থত,
নারীবাদ অনুসারে যে রাজনীতি নারীর অস্তিত্বকে ও তার ক্ষমতায়নের পরিধিকে বিকৃত ও সীমিত করে তার বিলোপ করা প্রয়োজন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ওপর পুরুষদের নানারকম কর্তৃত্ব আরোপ, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে নারীবাদ হল এক প্রকারের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে নারীকে দেখা হয়েছে একটি নিপীড়িত শ্রেণি হিসেবে।
 
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সমাজে যেমন সামাজিক শ্রেণিভেদ, জাতিভেদ কিংবা বর্ণভেদ বিদ্যমান তেমনই লিঙ্গভেদ (gender division)-ও একটি বৈষম্যমূলক বিভাজন যার দ্বারা নারীদের সামাজিক-বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে।
 
এই কারণে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এমন একটি সামাজিক-বিশ্লেষণ যেখানে নারীদের অবস্থান, মর্যাদা, তাদের অধিকার ও বিভিন্ন প্রকারের সুযোগ সুবিধা এবং সমাজে তাদের ভূমিকা প্রভৃতি প্রসঙ্গগত বিষয়গুলিও বিচার বিশ্লেষণ করে।

পঞ্চমত, নারীবাদ হল এমন একটি মতাদর্শ যেখানে নারীসমাজের পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ কেবলমাত্র নারীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি প্রদান সম্পর্কিত বিচার-বিশ্লেষণই এই দৃষ্টিতে আলোচিত হয় না-এই দৃষ্টিভঙ্গি চায় নারীদের সামাজিক বৈষম্যগুলিকেও পরিবর্তন করতে।

নারীবাদ একটি বৌদ্ধিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় 1792 খ্রিস্টাব্দে মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট-এর লেখা 'A vindication of the Rights of woman' নামক বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, নারীদের সমানাধিকার প্রদানের দাবি প্রভৃতি তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এরপর থেকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে যেসব আলোচনা ও আন্দোলন লক্ষ করা যায় সেগুলিকে কয়েকটি তরঙ্গ (wave) হিসেবে ভাগ করে আলোচনা করা হয়।

প্রথম তরঙ্গ (First wave)

ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অষ্টাদশ শতকে নারীবাদ সম্পর্কিত আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। মার্কিন নারীবাদী চিন্তাবিদ মার্গারেট ফুলারের 'Woman in the Nineteenth Century' নামক গন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সাড়া পড়ে যায়।
 
সেনেকা ফল্স সম্মেলনে 1948 খ্রিস্টাব্দে নারীর সমানাধিকার ও দাস-প্রথা বিরোধী বিষয় নিয়ে সকলে সোচ্চার হয়। এইসময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে নাগরিক হিসেবে নারীর স্বীকৃতি, নারীর ভোটাধিকার, আইনের দৃষ্টিতে লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন মুখর হয়ে ওঠে।
 
আমেরিকায় গড়ে ওঠে American Woman Suffrage Association, এদের মূল দাবি ছিল 'নারীর ভোটাধিকার'। 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের সময় নারীর অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা একদিকে যেমন রাজতন্ত্রের অবসান চেয়েছিলেন, অন্যদিকে তাঁরা চেয়েছিলেন পারিবারিক জীবনে পুরষের আধিপত্যের অবসান।
 
ফ্রেডারিখ এঙ্গেল্স তাঁর 'The origin of the family, Private Property and the state' নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উদ্ভবের সাথে নারীদের ওপর শোষণ-নির্যাতন কতখানি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

দ্বিতীয় তরঙ্গ (Second wave)

সিমন ডি বোভোয়া (Simone de Beauvoir) রচিত 'The Second Sex' প্রকাশিত হবার পর নারীবাদী চিন্তায় এক নতুন দিগন্ত লক্ষ করা যায়। এইসময় প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের সিনেমা, দূরদর্শন এমনকী সাহিত্যেও নারীদের একজন সফল জননী তথা একজন সফল স্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
 
এই গ্রন্থে বোভোয়া দেখালেন আইনগত ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে সাম্য থাকা সত্ত্বে নারীদের রেখে দেওয়া হয়েছে নিম্নতম অবস্থানে। বেটি ফ্রিয়েদান রচিত 'The Feminine Mystique'-এ দেখালেন নারীকে গৃহকর্মের মধ্যে বন্দি রাখার অথই হল সামাজিক ও জাতীয় সম্পদের অপচয় করা। ব্রিটেনে এই সময় নারীশ্রমিকদের জন্য সমমজুরির দাবিতে আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে। তবে 1980 দশকের শুরুতেই দ্বিতীয় তরঙ্গ থিতিয়ে পড়তে শুরু করে।

তৃতীয় তরঙ্গ (Third wave)

1990-এর দশকের শুরুতে তৃতীয় তরঙ্গের সূত্রপাত। এই তরঙ্গে নারীদের বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরা হয়। তা ছাড়া এই তরঙ্গ মনে করে যে নারী যেহেতু সমধমীয় বর্গ নয়, সেহেতু বর্গ, ধর্ম, সংস্কৃতি, শ্রেণি, রাষ্ট্র প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই বিভিন্ন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত।
 
যেমন, ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, এখানে 'দলিত' সম্প্রদায়ভুক্ত নারীরা সামাজিক দিক থেকে লাঞ্ছিত এবং নিম্ন বর্গীয় বলে অত্যাচারিত। এই কারণে তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদ বিশ্ব-প্রচারের দিকে না ঝুঁকে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

চতুর্থ তরঙ্গ (Fourth wave)

নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গের সূত্রপাত ঘটে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। এই নারীবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হল Website, Social networking site প্রভৃতির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ও বিভিন্ন সংস্কৃতির নারীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে তাদের সমস্যা সম্পর্কে যেমন জানতে পারছে, তেমনই সমস্যাসমাধানের সূত্রও নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে।
 
এই তরঙ্গে ব্যক্তি নারীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এক্ষেত্রে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল সমষ্টি স্বার্থ। তাছাড়া এই তরঙ্গের আন্দোলনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পুর-অধিকার (Civil Rights) আন্দোলন ও গান্ধির প্রভাব লক্ষ করা যায়।

রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তাই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যে বিষয়গুলি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হল-

প্রথমত,
নারীকে মানবতার (humanity) একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে। এক্ষেতে পুরুষের সঙ্গে নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অভিন্নতার ধারণাটি স্বীকার করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, নারী ও পুরষের মধ্যে যে স্বাভাবিক জৈবিক পার্থক্য বিদ্যমান, সেই অনুযায়ী পুরষের থেকে নারীকে নিকৃষ্টতর হিসেবে সাবেকি চিন্তকরা মনে করেছেন। নারীবাদীরা সাবেকি চিন্তাধারার তীব্র নিন্দা করেছেন।

তৃতীয়ত,
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী ও পুরুষের ভিন্নতা ও অভিন্নতা থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ক্ষমতার ফলাফল ও সংগঠিত বিষয়কে। এক্ষেত্রে নারীবাদী চিন্তকগণ এমন একটি রণকৌশল গঠন করতে চেয়েছেন যার মধ্য দিয়ে সাবেকি চিন্তাধারা অনুসারে লিঙ্গগত কুমোচ্চ ব্যবস্থাকে দুর্বল করা যায় ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

পরিশেষে, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী ও পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে অস্বীকার করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু একে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করাও হয়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নারীর সংগ্রামের ক্ষেত্রে পুরুষরাও সাথি হতে পারে। এক্ষেত্রে নারীকে দেখা হয়েছে এক নিপীড়িত মানবগোষ্ঠী হিসেবে।
 

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যাখ্যা করো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url