নারীবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করো

নারীবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করো

নারীবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা

বিংশ শতকের সত্তরের দশকে 'নারীবাদ' লিঙ্গ-বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ হিসেব গড়ে উঠেছে। যদিও অষ্টাদশ শতকে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমানাধিকারকে কেন্দ্র করে নারীবাদী চিন্তাচেতনার উদ্ভব ঘটে।
 
বিংশ শতকের সত্তরের দশক থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বতন্ত্র মহিলা সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক প্রধানত এই সময় থেকে অসম জেন্ডার সম্পর্কগুলির অনুসন্ধান করতে গিয়ে নারীবাদী আন্দোলনের যে ধারাগুলিকে তুলে ধরেন, তা হল-

[1] চরমপন্থী বা র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ

যে সমস্ত নারীবাদী বিংশ শতকের সত্তরের দশকে নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁরা র‍্যাডিক্যাল বা চরমপন্থী নারীবাদী নামে পরিচিত। এঁদের দৃষ্টিতে সকল সমাজই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এবং সমাজের চূড়ান্ত বিভাজন হল 'জেন্ডার' বিভাজন।
 
এঁরা মনে করেন যে, পুরুষ জাতি একটি বর্ণ হিসেবে নারীদের শোষণ করে এবং সামাজিক সকলপ্রকার সুবিধা তারা ভোগ করে, নারীরা সেগুলি থেকে বঞ্চিত হয়। তাই র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ দেশ-কাল-জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নারীকে একটি বর্গ হিসেবে পরিগণিত করতে চায়।
 
র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ সমাজে পুরুষের আধিপত্যের মূল জৈবিক কারণকে তুলে ধরেছেন এবং সামাজিকীকরণের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বেেল ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ এঁদের মতে শৈশবকাল থেকেই যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সন্তানদের বড়ো করে তোলা হয় তার মধ্যেই নিহিত থাকে লিঙ্গ-বৈষম্যের ধারা। র‍্যাডিক্যাল নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন-সিমন ডি বোডায়া (Simone De Beauviour), ব্রাউমিলার, কেউমিলেট প্রমুখ।

[2] সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ

যে নারীবাদী চিন্তাধারা মার্কসবাদের দ্বারা প্রভাবিত তাদের বলা হয় সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ। এঁদের মতে, সামাজিক শোষণব্যবস্থার একটি অঙ্গ হল লিঙ্গ-বৈষম্য। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ মার্কস রচিত 'German Ideology' (1846) এবং এঙ্গোল্স রচিত 'The origin of the family, Private Property and the state' (1884) নামক বইদুটির দ্বারা প্রভাবিত হন এবং বলেন যে, সমাজে নারীদের বৈষম্যমূলক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে অর্থনৈতিক কারণ, জৈবিক কারণ নয়।
 
মার্কস ও এঙ্গেল্স তাঁদের গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি লিঙ্গ-বৈষম্যের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এঙ্গেলের আলোচ্য গ্রন্থটি অনুসরণ করে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা দেখান যে, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষ ছিল সমকক্ষ। কিন্তু শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজ হয়ে পড়ে প্রেপিভিত্তিক। এই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে একদল নারীকে সরিয়ে নিয়ে গৃহকর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করল।
 
এই সমাজে নারীদের কাজ হল সন্তান প্রজনন ও পালন, গৃহকর্ম ইত্যাদি। অর্থাৎ তাদের বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গৃহবন্দি ও পরাধীন করে ফেলো সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ আরও মনে করে যে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদ তার নিজের প্রয়োজনে প্রচলিত পিতৃতন্ত্রকে ব্যবহার করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে পরিবর্তন করে।

[3] উদারনৈতিক নারীবাদ

র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদের দ্বারা সমান্তরালভাবে উদারনৈতিক নারীবাদ প্রভাবিত হয়েছে। অবশ্য উদারনৈতিক নারীবাদীরা র‍্যাডিক্যাল ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদের মতো নারী শোষণের ও নির্যাতনের কাঠামোগত বিশ্লেষণকে অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাননি।
 
তাঁরা সমাজে নারীর অবস্থানকে দেখেছেন পুরুষ ও নারীকে দু'রকমভাবে সামাজিকীকরণ করা, যুক্তিহীন সামাজিক বিষয়গুলিকে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের মধ্যে নারীকে আচ্ছন্ন করে ফেলা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে। এই ধরনের নারীবাদীরা তাই নারীদের সমানাধিকার প্রদান, আইনগত সংস্কার, চিন্তাধারার পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্যে সমাধানের পথ খুঁজেছেন।

[4] পরিবেশ সচেতন নারীবাদ

বিংশ শতকের আশির দশকে পরিবেশ সচেতন নারীবাদের উদ্ভব হয়। পুরুষশাসিত সামাজিক ব্যবস্থার পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নারীরা যে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে বলা হয় 'পরিবেশ সচেতন নারীবাদ'। এই ধারার নারীবাদীরা মনে করেন নারী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে-তাই, পরিবেশ শোষণ ও নারী শোষণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা মনে করেন, মানুষের অধীনে প্রকৃতি ও পুরুষের অধীনে নারীরা হয় শোষিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত।
 

[5] বিনির্মাণবাদী নারীবাদ

এই ধারার নারীবাদীরা একইরকম পরিস্থিতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের একই ধরনের অধিকার দানের কথা বলেছেন। নারীবাদের জন্য কোনোরূপ বিশেষাধিকারকে তাঁরা গ্রাহ্য করেন না। কারণ বিশেষাধিকার লিঙ্গ-বৈষম্যকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাই তাঁরা উভয়ের সমানাধিকারের কথা বলেছেন।

[6] মানবতাবাদী নারীবাদ

মানবতাবাদী নারীবাদীরাও বিনির্মাণবাদী নারীবাদের মতো লিঙ্গ-বৈষম্যের অবসানের জন্য নারীদের জন্য কোনো বিশেষাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনকে মেনে নেননি বা সমর্থন করেননি। তাঁরা চেয়েছেন সমাজে পৌর, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদ না করে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এর ফলেই সমাজ থেকে লিঙ্গ-বৈষম্যের অবসান ঘটতে পারে।

[7] নারীসমস্যাকেন্দ্রিক নারীবাদ

এই ধারার নারীবাদীরা চেয়েছেন নারীদের জন্য আলাদা করে কোনো সুবিধা প্রদান নয়, বরং গৃহ, কর্মক্ষেত্র প্রভৃতি সকলক্ষেত্রেই সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। কারণ নারীসমস্যার মূল ক্ষেত্র হল পরিবার ও প্রাইভেট ক্ষেত্র। এইসব ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে লিঙ্গ-বৈষম্য থেকে নারীরা মুক্তি পাবে।

উপসংহার

নারীবাদের ওপর আলোচিত এই ধারাগুলির মধ্যে মতভেদ থাকলেও একথা স্পষ্ট যে সমস্ত নারীবাদী ২২ ধারার আন্দোলনই চেয়েছেন নারীদের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বৈষম্য, শোষণ, অত্যাচার, আইনের ফাঁক, বিশেষাধিকার, অমযাদা, অবহেলা, বন্ধনা প্রভৃতির হাত থেকে মুক্তি এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পুরুষ- আধিপত্যের বিলোপসাধন।
 

0/Post a Comment/Comments