মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি আলোচনা করো

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি আলোচনা করো নিয়ে আলোচনা করব।

মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি আলোচনা করো

মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি

ফ্যাসিবাদ বলতে এমন একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে এইরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনোপ্রকার বিরোধিতা বা সমালোচনা সহ্য করা হয় না। যেখানে শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি সকল বিষয়ই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং যে শাসনব্যবস্থায় প্রাধান্য পায় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিস্ট বিরোধিতা। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চরম প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ফ্যাসিবাদের মূল উদ্দেশ্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিপুল জনসমর্থন আদায়ের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিবৈষম্য, ইহুদি-বিদ্বেষ, বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রভৃতি ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব কালে বিশেষ ভাবে সক্রিয় ছিল।

তা ছাড়া তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্রদ্র্য, পুঁজিবাদী অর্থনীতির নগ্ন প্রতিযোগিতা, পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রভৃতি কারণে ইউরোপ তথা ইতালি ও জার্মানির জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদ।

ইংরেজি 'Fascism' শব্দটি এসেছে ইতালীয় 'Fascism' শব্দ থেকে। আবার 'Fascio' শব্দটি লাতিন 'Fasces' শব্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যার অর্থ এক গুচ্ছ লাঠি ও একটি কুঠার দ্বারা শৃঙ্খলিত রূপ।

অর্থ, এর দ্বারা যে বিষয়গুলিকে ইঙ্গিত করা হয়, সেগুলি হল- 'সংহতি', 'ক্ষমতা' বা 'শক্তি', 'বাধ্যকতাবোধ' প্রভৃতি। ইতালিতে মুসোলিনি ও জার্মানিতে হিটলার দেশের এরূপ সংকটময় মুহূর্তে মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হন এবং ফ্যাসিবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আন্দোলন, শ্রমিক সংগঠন, বিশেষ করে কমিউনিস্ট আন্দোলন তাদের আক্রমণের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই জঙ্গি রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থায়িত্বকাল স্বল্প হলেও সমগ্র বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে তা ভাবিয়ে তুলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে।

ফ্যাসিবাদের তত্ত্বটি যাঁদের হাত ধরে বিকশিত হয়, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- জার্মান দার্শনিক খ্রিষ্কে, নিসে, ইতালির দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেজোলিনি, জিওভিন্নি জেন্টাইল, গ্যাব্রিয়েল ডি অ্যানানজিও প্রমুখ।

ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন (totalitarian) বৈশিষ্ট্য বা দিকটি তুলে ধরতে চায়। এই মতাদর্শ অনুসারে সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানকল্পে যে সংহতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়, সেখানে অন্য কোনো মতের গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী মতই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত বলে এই মতবাদ মনে করে।

তারা চায় দেশের সব রকমের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন সাধিত হবে ফ্যাসিস্ট মতানুসারে। এই কারণে তাদের কাছে যা প্রতিষ্ঠা করা চিন্তার বাইরে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলপ্রয়োগেও তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করে না। দ্বিতীয় কোনো মতপ্রকাশের এখানে সুযোগ নেই।

মুসোলিনি মনে করতেন সব কিছুই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাষ্ট্র-বহির্ভূত কোনো কিছু নয়। এখানে হেগেলীয় দর্শনের বিষয়টি উদ্ভাসিত হয়েছে। কারণ রাষ্ট্রকে হেগেল এমন একটি স্বাধীন সত্তা বলেছেন, যার আছে, 'প্রকৃত ইচ্ছা' (real will), যা গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে প্রকাশ করে না।

ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। এই ব্যবস্থায় কোনো বিরোধী দল থাকুক- ফ্যাসিবাদ তা চায় না। ফ্যাসিবাদ চায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সংকুচিত করতে।

ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে হিংসার আশ্রয়গ্রহণ এক অন্যতম পদ্ধতি। বিরোধী শক্তিদের উচ্ছেদ- ফ্যাসিবাদ ঘোষিত অপর এক নীতি। ফ্যাসিবাদ অনুযায়ী সর্বক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রসৃষ্টির একটি উদ্দেশ্য হল এর মাধ্যমে হিংসা প্রকাশের সুযোগ। ফ্যাসিবাদ যে রাষ্ট্রব্যবস্থার উপস্থাপন করে, তা হল নৈতিক ও আদর্শগত বা ভাবগত অস্তিত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র।

ফ্যাসিবাদে নারী স্বাধীনতা সংকুচিত। হিটলার মনে করেন, নারীর লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল জার্মান যোদ্ধার জন্মদান। তাই তিনি তাদের অর্থনৈতিক কাজ থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দি করে রাখার কথা বলেন। অর্থাৎ নারী স্বাধীনতায় ফ্যাসিবাদের আস্থা ছিল না।

ফ্যাসিবাদ তার প্রচারকার্যে উগ্র জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে ঘৃণা ও সন্ত্রাস, প্রতিহিংসাপরায়ণতার উদ্ভব ঘটায়। এর মধ্য দিয়ে উদারনীতিবাদ, প্রগতিবাদ, মুক্ত অর্থনীতি প্রভৃতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ট্রিঙ্কে রাষ্ট্রকে শক্তির প্রতীক বলেছেন এবং শক্তি বা ক্ষমতাকেই পূজা বলে ধরেছেন।

এই মতানুসারে, ক্ষুদ্র বা ছোটো রাষ্ট্র হল পাপের প্রতীক। তাই ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। এক্ষেত্রে যুদ্ধ কোনো অন্যায় কাজ নয়।

পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করলেও তারা ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা জনসাধারণের আনুগত্য কামনা করে এবং তাদের ওপর বিপ্লবী পন্থায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিস্থাপনে বিশেষভাবে আগ্রহী।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি আলোচনা করো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url