জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করো

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করো নিয়ে আলোচনা করব।

জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করো

জনকল্যাণকর/জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র

আধুনিক কালের বিশ্বব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হয় না। এই দুই চূড়ান্ত ব্যবস্থার মধ্যবর্তী এক অবস্থা গ্রহণ করা হয় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায়। কারণ এরূপ ব্যবস্থায় একদিকে যেমন ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়; অনাদিকে তেমনই জনকল্যাপের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্র ওই সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করতে পারে।

অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তত্ত্ব থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব গ্রহণ করেছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা এবং সমাজতন্ত্রবাদ থেকে নিয়েছে সমাজকল্যাণের নীতি। তাই এইরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে (অর্থাৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বার্ধক্য ও পীড়িত অবস্থায় সাহায্যদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে) নানা রকমের কর্মসূচি গ্রহণ করে।

জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

ক্রিস্টোফার পিয়ারসন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, ব্যক্তির অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং তার জীবনের সুযোগসুবিধাগুলি বণ্টন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশেষভাবে হস্তক্ষেপ করে, তাকে বলা হয় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জি ডি এইচ কোল বলেছেন, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রত্যেকের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য এবং বিভিন্নপ্রকার সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তাকে বলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।

আবার, ও ড্রেসিংগার জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার সকল নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, বাসস্থান প্রভৃতি সুযোগসুবিধা প্রদান করে তাকে বলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। কার্যাবলি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনসাধারণের সার্বিক বিকাশসাধন ও বিভিন্ন সুযোগসুবিধা প্রদানের জন্য কতকগুলি কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং সেগুলি রূপায়ণ করে। এই কর্মসূচির অন্তর্গত বিষয়গুলি হল-

[1] মৌলিক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বেশ কিছু মৌলিক কাজ সম্পাদন করে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-বহির্শক্তির আক্রমণ থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করা ও দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নাগরিকদের বাক্তিগত নিরাপত্তা দানের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করা, বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করা, জনগণ যাতে ন্যায় বিচার পায় তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

[2] সামাজিক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সামাজিক কল্যাণের জন্য বিভিন্ন কাজ করে থাকে। যেমন- শ্রমিকরা যাতে শোষিত না হয় তার জন্য শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঠিক করে দেওয়া, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করা, ভারতের মতো কল্যাণকর রাষ্ট্রে জাতিভেদ, পণপ্রথা প্রভৃতির হাত থেকে মানুষকে মুক্তিদানের জন্য আইন প্রণয়ন, তা ছাড়া বৃদ্ধ, অক্ষম ও পীড়িত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং সহায়তার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

[3] সম্পত্তি সংরক্ষণমূলক কার্যাবলি: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ব্যক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এই অধিকার প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। অর্থাৎ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্র দ্বারা সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু জনকল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্র যদি মনে করে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তবে সে তা করতে পারে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইন অকল্যাণকর বলে বিবেচিত হয় না।

[4] অর্থনৈতিক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র নাগরিকদের সর্বাধিক কল্যাণের স্বার্থে যেসব কার্য সম্পাদন করে থাকে, সেগুলি হল-ভূমিসংস্কারমূলক কাজ, দরিদ্র ও প্রাপ্তিক চাষিদের জন্য ঋণ ও বিভিন্ন রকমের সুযোগসুবিধা প্রদান, দেশের অভ্যন্তরে যাতে কালোবাজারী ও মজুতদারি গড়ে উঠনে না পারে তার ব্যবস্থা করে, সকলের কল্যাণোপযোগী উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, বেকার সমস্যা- সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। মূলত জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রসর হয় তার লক্ষ্য হল সমাজকল্যাপের জন্য উৎপাদন করা।

[5] রাজনৈতিক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজও সম্পাদন করতে হয়। কোনো রাষ্ট্রের প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়লে সেই রাষ্ট্রের জনকল্যাণ ব্যাহত হয়, তাই দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করা, জনগণের শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগসৃষ্টি, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এই কার্যাবলির অন্তর্গত।

[6] সাংস্কৃতিক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র শিল্প-সাহিত্যের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তা ছাড়া বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার উন্নতিবিধান, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সর্বজনীন শিক্ষার প্রসারের জন্য নানা গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

[7] পরিবার বিষয়ক কার্যাবলি: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদমূলক আইন, পরিবার-পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হয়।

মূল্যায়ন

জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনকল্যাণের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিভিন্ন দিক থেকে এটি সমালোচিতও হয়েছে।

প্রথমত, 'The Political Economy of Capitalism' নামক গ্রন্থে মার্কসীয় চিন্তাবিদ ডি আফানাসিয়েড মন্ডবা করেছেন যে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র আসলে এমন একটি ছদ্মবেশ যার দ্বারা রাষ্ট্র তার একচেটিয়া পুঁজিবাদকে আড়াল করতে চায়।

দ্বিতীয়ত, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র শ্রেণিবিরোধকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। জনকল্যাণের জন্য এই রাষ্ট্র বিভিন্ন ব্যবস্থাগ্রহণ ও অর্থব্যয় করলেও, আদায়ীকৃত করের একটা বড়ো অংশ খরচ হয় পুলিশবাহিনী, সৈন্যবাহিনী, অস্ত্রসম্ভার বাড়ানো, সরকারি প্রশাসনকে জোরদার করা প্রভৃতি অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলিতে।

তৃতীয়ত, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যক্তির শ্রম ও মজুরির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, কিন্তু লাগামছাড়া মুনাফা বৃদ্ধি ও মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়নি। এই কারণে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে ধনী- দরিদ্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থেকেই গেছে।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url