বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী? এটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী? এটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী? এটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? অথবা, বাংলাদেশে বন্যার কারণসমূহ উল্লেখ কর। অথবা, বাংলাদেশের বন্যার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা কর। অথবা, বাংলাদেশ ঘন ঘন বন্যা পীড়িত হয় কেন? বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বর্ণনা কর।
ভূমিকা
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যা সমস্যা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এদেশের প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হয়। বিংশ শতক থেকে এ পর্যন্ত বড় ধরনের বন্যাই হয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং সাম্প্রতিক ২০২২ সালের বন্যা স্মরণকালের মধ্যে নজিরবিহীন। বাংলাদেশের অর্থনীতেতে বন্যা একটি গুরুতর সমস্যা।
এ বন্যার ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হয় এবং অসংখ্য মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ছাড়াও কোটি কোটি টাকার ফসল ও সম্পদ বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির মূলে বন্যা অধিকতর কাজ করে। বন্যা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বারবার বাধা প্রদান করে আসছে। বন্যা: বন্যার বিভিন্ন সংজ্ঞা দেয়া যায়। যেমন-
কোনো স্থানে আকস্মিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পানির প্রবাহ ঘটলে, তাকে বন্যা বলে।
জনৈক বিশেষজ্ঞের মতে, "নদী বা খালে হঠাৎ বৃষ্টি, স্রোত অথবা অন্য কোনো কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে অত্যধিক পানি হয়ে চারদিক ভাসিয়ে দেয়ার নামই বন্যা।
কোনো নদী-নালা ও নিম্ন ভূমির জলধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রবাহ দু'কূল ছাপিয়ে যদি পারিপার্শ্বিক ভূমি ও জনপদ প্লাবিত করে দেয়, তবে তাকে বন্যা বলে।
বাংলাদেশের বন্যার কারণ
যেসব কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয় তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো। যেমন-
১। ভূমিরূপ ও গঠন প্রকৃতি:
বাংলাদেশের পাহাড়িয়া এলাকা, মধুপুরের ও ভাওয়ালের এবং উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমি এলাকা ব্যতীত দেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮ মিটারের মধ্যে অবস্থিত। এছাড়া এদেশের সমতল ভূমি অঞ্চলে ভূমির ঢাল কম হওয়ায় পানি সহজে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হতে পারে না। ফলে পারিপার্শ্বিক ভূমি ও জনপদ প্লাবিত হয়ে যায়।
২। অতিবৃষ্টি:
বাংলাদেশে বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অত্যধিক বৃষ্টিপাত। মৌসুমি বায়ুর প্রবাহে বাংলাদেশে কোনো কোনো বছর অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়। এ অতি বৃষ্টির পানি নদী স্রোতে যোগ দিয়ে নদীর দু'কূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
৩। অত্যধিক বরফ গলা পানি:
হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে বরফগলা পানির ফলেও দেশের বন্যা দেখা যায়। বরফগলা পানির পরিমাণ যখন অত্যধিক হয় তখন তা বিভিন্ন নদী পথে দ্রুত গতিতে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়।
৪। নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস:
দেশের নদীগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি নদীর দু'কূল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয়।
৫। খাল ও নালার অভাব:
বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত নদীতে সরে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাল ও নালা থাকায় মাঠ-ঘাটে ও গ্রামাঞ্চলে প্লাবন ঘটে। ফলে দেশে বন্যা দেখা দেয়।
৬। নিচু ভূমি:
বাংলাদেশের সিলেট ও ফরিদপুর জেলার কিছু কিছু অঞ্চল বেশ নিচু। এ সকল নিচু জলাবদ্ধ অঞ্চলে পূর্বের পানির সাথে বৃষ্টির পানি মিশে আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে ফেলে।
৭। নদীর বাঁক:
স্রোতের বেগ কম হলে নদীর বাঁকগুলোতে পলি মাটি জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়।। সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ। এভাবে নদীর বাঁকসমূহ বন্যার সৃষ্টি করে থাকে। ভরাট নদী বন্যা
৮। বনভূমি হ্রাস:
বনজ সম্পদ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ফলে বনাঞ্চলের পানি বাধাহীনভাবে দ্রুত নদীতে পড়ে। ফলে নদীতে পানির পরিমাণ হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
৯। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস:
বাংলাদেশের বন্যার অন্যতম কারণ হলো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। অনেক সময় সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টির ফলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়ে থাকে।
১০। উজানে পানি প্রত্যাহার:
ভারত কর্তৃক ফারাক্কাসহ বিভিন্ন নদীর উজানে অসংখ্য বাধ নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীর স্রোত কমে যায়। ফলে পলি জমে নদীর নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এতে নদীর উভয় পার্শ্ব ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্ট হয়।
১১। রাস্তাঘাট ও রেললাইন:
নতুন নতুন রাস্তাঘাট ও রেললাইন কোনো কোনো অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে বন্যা ঘটায়।
১২। নদীর পানি বহন ক্ষমতা:
বাংলাদেশে প্রধান নদী তিনটি। পাহাড়িয়া অঞ্চলের অফুরন্ত পানি রাশিকে বহন করার মতো ক্ষমতা এ নদীগুলোর নেই। ফলে প্রতি বছর বর্ষা ঋতুতে এ নদীসমূহে দু'কূল ছাপিয়ে বন্যা। সৃষ্টি হয়।
১৩ । পরিকল্পনাবিহীন রাস্তাঘাট:
বাংলাদেশে অনেক পরিকল্পনাবিহীন রাস্তাঘাট রয়েছে। তা ছাড়া পর্যাপ্ত পুল ও কালভার্ট নেই। বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারে না, ফলে বন্যা সৃষ্টি হয়।
১৪। নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া:
বর্ষাকালে পলিমাটি ক্রমে ক্রমে নদী গর্ভে সঞ্চিত হয়ে নদীর তলদেশকে ভরাট করে ফেলে। হলে নদীতে পানির স্থান সঙ্কুলান হয় না। ফলে স্থলভাগকে প্লাবিত করে।
তখন অতিবৃষ্টি বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা সমস্যা সমাধানের উপায় বা পদ্ধতিঃ বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের ক্রুগমিশন ১৯৮৭ সালে, জেনারেল হার্ডিং ১৯৬৩ ও '৬৪ সালে এবং প্রফেসর ঘিজেসের প্রস্তাব ও সর্বোপরি তৎকালীন "পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ" এর উদ্যোগে মার্কিন প্রতিষ্ঠান "ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি" ৫ বছর গবেষণায় ১৯৬৪ সালে ৯০ বছর মেয়াদি
যে মহাপরিকল্পনার সুপারিশ করেন তার আলোকে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বা পদ্ধতিসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হয়:-
১। বাঁধ নির্মাণ:
বড় বড় নদী ও খালের উভয় তীরে বাঁধ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে বন্যার প্রকোপ হতে রক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার হাত হতে কৃষি ভূমি রক্ষার জন্য সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
২। নদীর তলদেশ গভীর করা:
বাংলাদেশে যে সকল নদী ভরাট হয়ে গেছে সে সকল নদী ড্রেজার দিয়ে খনন করে নদীর তলদেশ গভীর করতে হবে।
৩। খাল ও নালা পুন: খনন:
বৃষ্টির পানি যাতে বড় বড় নদীতে দ্রুত নেমে আসতে পারে তার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক খাল ও নালা খনন করতে হবে।
৪। খাল ও নর্দমার সংযোগ সৃষ্টি:
অনেক অঞ্চলে বৃষ্টির পানি জমে বন্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু ঐ সমস্ত অঞ্চলের সাথে খাল ও নর্দমার সংযোগ সৃষ্টি করতে পারলে বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৫। নদীর গতি পরিবর্তন:
প্রয়োজনবোধে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
৬। পরিকল্পিত উপায়ে রাস্তা নির্মাণ:
রাস্তা, রেলপথ ইত্যাদি নির্মাণকালে পানি প্রবাহের গতি ও প্রকৃতি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে এ সমস্ত নির্মাণ করা হলে অনেকাংশে বন্যার প্রকোপ হ্রাস করা সম্ভব।
৭। বড় বড় সেতু নির্মাণ:
নদীর উপর দিয়ে রেলপথ ও সড়ক পথ নির্মাণের সময় বড় বড় সেতু নির্মাণ করে অবাধে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। জলাধার সৃষ্টি:
সম্ভাব্য স্থানে উপযুক্ত জলাধার সৃষ্টি করে বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস করা সম্ভব হবে।
৯। বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ প্রচেষ্টা:
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীই ভারতের উপর দিয়ে এসেছে। কাজেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সার্থক রূপায়ণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেরই যৌথভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
১০। পানি নিষ্কাশন:
বাংলাদেশ পানি সম্পদ উন্নয়ন সংস্থা" পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ সমস্ত প্রকল্পের মধ্যে (ক) গোমতী নদী খনন, (খ) ফরিদপুর পানি নিষ্কাশন প্রকল্প, (গ) ডাকাতিয়া ও ফেনী নদী প্রকল্প ও (ঘ) যাদুকাটা বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। অধুনা "ওয়াপদা" এ পর্যন্ত পাঁচটি বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ পানি সেচ কর্মসূচির কাজ শেষ করেছে এবং আরও ২৫টি প্রকল্পের কাজ চলছে। উপরিউক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বন্যার প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী? এটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url