পৃথিবীর খনিজ তেলের উৎপাদন, বণ্টন ও বিশ্ব বাণিজ্য বর্ণনা কর

পৃথিবীর খনিজ তেলের উৎপাদন, বণ্টন ও বিশ্ব বাণিজ্য বর্ণনা কর

পৃথিবীর খনিজ তেলের উৎপাদন, বণ্টন ও বিশ্ব বাণিজ্য বর্ণনা কর। অথবা, খনিজ সম্পদ বলতে কী বুঝ? পৃথিবীর খনিজ তৈল উৎপাদন ও বাণিজ্য সম্পর্কে আলোচনা কর। অথবা, পৃথিবীর প্রধান প্রধান খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশের বর্ণনা দাও। অথবা, চিরহরিৎ খনিজ তৈল উৎপাদনকারী দেশগুলোর নাম লেখ। অথবা, খনিজ সম্পদ কাকে বলে? পৃথিবীর প্রধান প্রধান খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশের বর্ণনা দাও।

ভূমিকা:

ভূ-ভাগের অভ্যন্তরে সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদকে খনিজ সম্পদ বলে। খনিজ তেল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির গতি এবং বেগ নিয়ন্ত্রণে খনিজ তেলের যতখানি গুরুত্ব ও প্রভাব রয়েছে অন্য কোনো খনিজ সম্পদের এত গুরুত্ব ও প্রভাব নেই। তেল বাজার নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলো চরম দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত।

খনিজ তেল উৎপাদন ও বণ্টন: পৃথিবীর খনিজ তেল উৎপাদক দেশের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক। ২০১০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বমোট প্রায় ৩৬৫ কোটি ২০ লক্ষ মেট্রিক টন খনিজ তেল উত্তোলিত হয়। খনিজ তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর মধ্যে রুশ ফেডারেশন বিশ্বে প্রথম, সৌদি আরব দ্বিতীয়, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়, চীন চতুর্থ, ইরান পঞ্চম, এবং ভেনিজুয়েলা ৬ষ্ঠ।

আরো পড়ুনঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাকে বলে? আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।


তবে বর্তমানে প্রথম ছয়টি দেশ হতে বিশ্বের প্রায় ৪৯.৫৫% তেল উত্তোলিত হয়। বিশ্বের তেল উৎপাদন ও বণ্টন নিম্নরূপঃ খনিজ তেল উৎপাদনকারী অঞ্চলকে ৬টি প্রধান অঞ্চল বা বলয়ে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-

  • ক) আমেরিকান তেল বলয়,
  • (গ) মধ্যপ্রাচ্যের তেল বলয়,
  • (ঙ) ইউরোপীয় তেল বলয় এবং
  • (খ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তেল বলয়,
  • (ঘ) আফ্রিকার তেল বলয়,
  • (চ) অস্ট্রেলিয়ার তেল বলয়।

(ক) আমেরিকান তেল বলয়:

আমেরিকান তেল বলয়ভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের মোট উৎপাদিত খনিজ তেলের প্রায় ৩০ ভাগ উৎপাদন করে। এ অঞ্চলের প্রধান তেল উৎপাদকারী দেশগুলো নিম্নরূপঃ

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: তেল উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান বর্তমান বিশ্বে তৃতীয়। ২০১০ সালে এদেশ ৩৭.৩৭ কোটি মেট্রিক টন খনিজ তেল উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস, ওকলাহোমা, আরাকানসাস, উত্তর টেকসাস, মনটানা প্রভৃতি অঞ্চল খনিজ তেলে সমৃদ্ধ।

২। মেক্সিকো: মেক্সিকো বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে এদেশ ১৩.৫০ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদন করে। মেক্সিকোর গুয়ানাজুয়াটা, ডুইরিটারো, পোপোকেটিপে ইউকাটান অঞ্চল খনিজ তেলের জন্য বিখ্যাত।

৩। ভেনিজুয়েলা: ভেনিজুয়েলা বিশ্বের ষষ্ঠ প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে এদেশে ১৪.৪৭ কোটি মেট্রিক টন খনিজ তেল উৎপাদিত হয়। এদেশের ম্যারাকা ইবো এবং ওরিনকো নদীর অববাহিকায় প্রচুর খনিজ তেল উত্তোলিত হয়।

৪। অন্যান্য দেশ: উপরিউক্ত দেশগুলো ছাড়াও আমেরিকান তেল বলয়ে অবস্থিত কানাডা, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, পেরু, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশেও খনিজ তেল উত্তোলন করা হয়।

আরো পড়ুনঃ ওয়েজ আর্নারস স্কিম কী? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব বর্ণনা কর।

(খ) ইউরোপীয় তেল বলয়:

১। রুশ ফেডারেশনঃ বর্তমানে রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে ৫০.৪৭ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদন করে। রাশিয়ার তাজিক, ইউরাল, কিরগিজ, আমুর নদীর অববাহিকা প্রভৃতি অঞ্চল খনিজ তেলে সমৃদ্ধ।

২। যুক্তরাজ্যঃ খনিজ তেল উৎপাদনে যুক্তরাজ্যের স্থান বর্তমান বিশ্বে পঞ্চদশ। ২০১০ সালে এদেশে ৫.৮০ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়। উত্তর সাগর উপকূলীয় এলাকা যুক্তরাজ্যের প্রধান তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল।

৩। রুমানিয়া: রুমানিয়া ইউরোপের তৃতীয় প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। এদেশের প্রধান তেলক্ষেত্রগুলো বুজান, পারহোভা, বাকাউ, ডামবোরিজা এবং সিবিটিতে অবস্থিত।

৪। অন্যান্য: ইউরোপের অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো- ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জনগণের স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণ ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোচনা কর।

(গ) মধ্যপ্রাচ্যের তেল বলয়:

১। সৌদি আরব: তেল উৎপাদনে সৌদি আরবের স্থান বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয়। ২০১০ সালে এদেশের ৪০.৭০ কোটি মেট্রিক টন খনিজ তেল উত্তোলিত হয়। সৌদি আরবের হাসা, সাকানিয়া, আবকাইক, দাম্মাম, মারজান, বারগান, হুফুফ, দাহরান, কুয়াতিক অঞ্চল খনিজ তেলের জন্য প্রসিদ্ধ।

২। ইরান: এটি বিশ্বের চতুর্থ তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে এদেশ ১৭.৫৯ কোটি মেট্রিক টন খনিজ তেল উৎপাদিত হয়। ইরানের প্রধান তেল খনিগুলো মসজিদ-ই-সুলায়মান, লালী, নাফট সাফিদ, আঘাজারি, হাফট কেল, হামাদান প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত।

৩। কুয়েত: মধ্যপ্রাচ্যের নবম তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে এদেশে ১১.৬৪ কোটি মেট্রিক টন তেল উত্তোলন হয়। পৃথিবীর মোট সঞ্চিত তেলের প্রায় ১০% এখানে বিদ্যমান। বারগান, মাগওয়া, আহামাদি এদেশের শ্রেষ্ঠ তেল উৎপাদনকেন্দ্র।

৪। অন্যান্য: মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো- ইরাক, ওমান, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, তুরস্ক, মিশর প্রভৃতি।

আরো পড়ুনঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলতে কী বুঝ? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা ও অসুবিধা লেখ।

(ঘ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তেল বলয়:

১। চীনঃ খনিজ তেল উৎপাদনে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং বিশ্বে চতুর্থ। ২০১০ সালে এদেশে ২০.২০ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়। চীনের কারমাই, লেঙহু ও সাইডাম অববাহিকা, কানসু প্রদেশের ইউমেন, নাচুং প্রভৃতি অঞ্চল খনিজ তেলে সমৃদ্ধ।

২। ইন্দোনেশিয়া: খনিজ তেল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয়। এদেশের সুমাত্রা, জাভা কালিমাস্তান দ্বীপে প্রচুর তেল পাওয়া যায়। ২০১০ সালে এদেশে ৪.৬১ কোটি মেট্রিক টন তেল উত্তোলিত হয়।

৩। অন্যান্য দেশ: উপরিউক্ত দেশগুলো ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাপান, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি দেশেও খনিজ তেল উত্তোলিত হয়।

আরো পড়ুনঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলতে কী বুঝ? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা ও অসুবিধা লেখ।

(ঙ) আফ্রিকান তেল বলয়:

১। নাইজেরিয়া: খনিজ তেল উৎপাদনে নাইজেরিয়ায় স্থান বর্তমান বিশ্বে দ্বাদশ। ২০১০ সালে এদেশে প্রায় ১২.০০ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়। নাইজেরিয়ার ল্যাগোস এবং নাইজার নদীর অববাহিকা অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে খনিজ তেল উত্তোলিত হয়।

২। লিবিয়াঃ লিবিয়া বিশ্বের ত্রয়োদশ খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০১০ সালে এদেশে ৭.১৫ কোটি মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়। লিবিয়ার প্রধান তেল ক্ষেত্রগুলো দাহারান, জেলটেন এবং হমস অঞ্চলে অবস্থিত। ৩। আলজেরিয়া : এটি আফ্রিকার অন্যতম খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ। এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫.৪০ কোটি মেট্রিক টন। আলজেরিয়ার পূর্ব সীমান্তের হাসিমাসাউদ এবং ইজেলী তেল উত্তোলনে প্রসিদ্ধ।

আরো পড়ুনঃ মৌসুমি অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক কার্যাবলি কী?

(চ) ওসেনিয়ার তেল বলয়:

এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে খনিজ তেল পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২ কোটি ৩৩ লক্ষ মেট্রিক টন। খনিজ তেলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য:

রপ্তানিকারক দেশসমূহঃ খনি হতে উত্তোলিত অপরিশোধিত তেল রপ্তানিতে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইরান, ভেনিজুয়েলা, ইরাক, আলজেরিয়া, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ। আমদানিকারক দেশসমূহ: আমদানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কলম্বিয়া, পেরু, ভেনিজুয়েলা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, জাপান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মূলত OPEC (Organiastion of Petrolium Exporting Countries) বিশ্বের খনিজ তেলের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উপসংহারঃ খনিজ তেল, একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ। বিশ্বের খনিজ তেলে সমৃদ্ধ দেশগুলো যথেষ্ট উন্নত। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ তেল 'তরল সোনা' হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের খনিজ তেল বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আরো পড়ুনঃ আধুনিক অর্থনীতিতে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব বর্ণনা কর।

0/Post a Comment/Comments