মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর নিয়ে আলোচনা করব।
মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর। অথবা, মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার জলবায়ু বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জলবায়ুগত অবস্থার উপর ভিত্তি করে যে বিভিন্ন জলবায়ু গড়ে উঠেছে তা মানুষের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। মূলত একটি দেশের বা অঞ্চলের মানুষের বাণিজ্য, জীবনযাত্রা প্রভৃতির উন্নতি ও অবনতির মূল কারণ হলো জলবায়ু।
অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে জলবায়ুর প্রভাব: নিচে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করা হলো:-
- কৃষিকাজঃ কৃষি থেকে মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া শিল্পের কাঁচামালসমূহও কৃষি থেকে পাওয়া যায়। অথচ কৃষিকাজের জন্য বিশেষ ধরনের জলবায়ু প্রয়োজন। যেমন- পরিমিত উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। ফলে দেখা যায়, যে এলাকায় সমভাবাপন্ন মৌসুমি জলবায়ু বিরাজমান সেখানে কৃষি প্রসার লাভ করেছে। যেমন- ভারতের পরিমিত বৃষ্টিপাত এবং অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতাসম্পন্ন জলবায়ু কৃষির জন্য বিশেষ উপযোগী। পক্ষান্তরে, কুয়েতের উষ্ণ মহাদেশীয় জলবায়ু কৃষির অনুপযোগী। সুতরাং দেখা যায়, কৃষিকাজের উপর জলবায়ুর প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক।
- পশুচারণঃ পশুচারণের জন্য তৃণভূমি দরকার। আর তৃণভূমি গড়ে উঠে কম বৃষ্টিপাত এলাকায়। অর্থাৎ যে এলাকায় সারাবছর কমবেশি বৃষ্টিপাত হয় সে এলাকায় তৃণভূমি ও পশু চারণক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। যেমন- অনুকূল মহাদেশীয় জলবায়ুর প্রভাবে এশিয়া ও ইউরোপের স্টেপস; দক্ষিণ আফ্রিকার ভেল্ড; উত্তর আমেরিকার প্রেইরি; দক্ষিণ আমেরিকার পাম্পস; অস্ট্রেলিয়ার ভাউন্স প্রভৃতি তৃণভূমি গড়ে উঠায় সেখানে পশুপালন শিল্পেরও প্রসার ঘটেছে। যার ফলে উক্ত এলাকার মানুষের প্রধান কার্যাবলি হলো পশুপালন, মাংস রপ্তানি ও দুগ্ধ উৎপাদন।
- বনভূমির উন্নতিঃ জলবায়ুর পার্থক্য হেতু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে। আবার কোথাও কোনো বন গড়ে উঠতে পারে নি। বনাঞ্চল গড়ে উঠার অনুকূল জলবায়ু হলো উষ্ণ ও প্রচুর বৃষ্টিপাতযুক্ত জলবায়ু। অনুকূল জলবায়ুর ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে নিবিড় বনভূমি গড়ে উঠেছে এবং কানাডা, আলাস্কা, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া প্রভৃতি এলাকায় সরলবর্গীয় বৃক্ষের বন সৃষ্টি হয়েছে। যথেষ্ট উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের কারণে আমেরিকায় আমাজান নদীর সেলভা অঞ্চলে, আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকা ও গিনি উপকূলে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়, মায়ানমার এবং বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় চিরহরিৎ বৃক্ষের বন গড়ে উঠেছে। মরুভূমিতে শুষ্ক জলবায়ুর কারণে কাঁটাগাছ ও বিভিন্ন ধরনের গুল্ম জন্মায়; যা উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার প্রিয় খাদ্য।
- মৎস্য চারণক্ষেত্র : জলবায়ুর কারণে নরওয়ে, জাপান প্রভৃতি এলাকায় মৎস্য চারণক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। ইউরোপের ডগার ব্যাংক মৎস্যের জন্য বিখ্যাত। মৎস্য চারণক্ষেত্রের অনুকূক্ত জলবায়ু হলো নাতিশীতোষ্ণ ও শীতল স্রোতের সঙ্গমস্থল। ফলে এ সমস্ত অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, চাষ ও ব্যবসায়ে নিযুক্ত রয়েছে অসংখ্য লোক। একমাত্র জাপানেই প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি লোক মৎস্য আহরণে জড়িত। নরওয়ে, ব্রিটেন, জাপান, পেরু প্রভৃতি দেশের মানুষের অন্যতম উপজীবিকা মৎস্য শিকার।
- উপজীবিকা ও কর্মদক্ষতা: জলবায়ুর দ্বারা মানুষের উপজীবিকা এবং কর্মদক্ষতাও প্রভাবিত হয়। প্রতিকূল জলবায়ু এলাকার মানুষের চেয়ে অনুকূল জলবায়ু এলাকার মানুষের উপজীবিকা ও কর্মদক্ষতাও বেশি। যেমন- শীত ও উষ্ণমণ্ডলের মানুষের তুলনায় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সহজ আর মরু ও পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন।
- শিল্পকারখানা স্থাপন ও স্থানীয়করণঃ শিল্পের স্থাপন ও স্থানীয়করণ অনেকটা নির্ভর করে উক্ত অঞ্চলের জলবায়ুর উপর। কেননা শিল্পের উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। যেমন- বস্ত্রশিল্পের জন্য আর্দ্র জলবায়ু খুবই উপযোগী। ফলে ম্যানচেস্টার, মুম্বাই, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে বস্ত্রশিল্প; ডান্ডি ও বাংলাদেশে পাট শিল্প; উজ্জ্বল সূর্যকিরণময় জলবায়ুর জন্য ক্যালিফোর্নিয়া, ইতালি, মুম্বাই, দক্ষিণ ফ্রান্স প্রভৃতি অঞ্চলে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ শিল্পের উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলেই অনেকগুলো শিল্প বিশেষ বিশেষ কতকগুলো এলাকায় স্থানীয়করণ হয়েছে। তা ছাড়া জলবায়ুর পরোক্ষ প্রভাবে মানুষের চাহিদা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে শিল্পকারখানা বিশেষ বিশেষ স্থানে স্থাপিত হয়েছে-শীতপ্রধান অঞ্চলে পশম শিল্প এবং গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে সুতি বস্ত্রের শিল্প গড়ে উঠেছে।
- পরিবহন ব্যবস্থা: পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠার উপরও জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। তাই লক্ষ্য করা যায়, কোথাও স্থলপথ, কোথাও রেলপথ, কোথাও নৌপথ এবং আকাশপথে পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং পরিবহনকে কেন্দ্র করে শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
- শিল্পের কাঁচামালের উপাদান: জলবায়ু শিল্পের কাঁচামালের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করেও পরোক্ষভাবে শিল্প স্থাপনে সাহায্য করে। যার ফলে কাঁচামাল উৎপাদিত এলাকায় শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন- বাংলাদেশে পাট শিল্প, ইংল্যান্ডে পশম শিল্প, হাভানায় তামাক শিল্প, নিউজিল্যান্ডে দুগ্ধ শিল্প প্রভৃতি গড়ে উঠেছে।
- শ্রমিকের কর্মদক্ষতা নিয়ন্ত্রণঃ জলবায়ু শ্রমিকের কর্মদক্ষতাও নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত এলাকার অধিবাসীরা অন্যান্য এলাকার অধিবাসীদের চেয়ে অলস ও কর্মদ্যোমহীন বেশি হয়ে থাকে। আর তাই বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকের সরবরাহ ও কর্মদক্ষতা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। ফলে শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে জলবায়ু, যা শিল্প স্থাপনে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যে-কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যাবলি উক্ত দেশের জলবায়ু দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। তবে এটিও সত্য যে, আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতির ফলে মানুষ জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেক স্থানে শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়েছে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url