লোহার গুরুত্ব কী? পৃথিবীর প্রধান প্রধান লোহা উৎপাদনকারী দেশের বর্ণনা কর
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে লোহার গুরুত্ব কী? পৃথিবীর প্রধান প্রধান লোহা উৎপাদনকারী দেশের বর্ণনা কর নিয়ে আলোচনা করব।
ভূমিকা: বর্তমান শিল্প জগতে লোহার ব্যবহার ও গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এর ব্যবহারিক গুরুত্বের কারণে বর্তমান যুগকে লোহা বা ইস্পাতের যুগ বলা হয়।
লোহার গুরুত্ব: লোহা শিল্প একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। লোহা শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্যাদি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, কলকারাখানার যন্ত্রাংশ, উড়োজাহাজ, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাক, বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহে ব্যবহারের বিভিন্ন প্রকার লোহাজাতীয় দ্রব্যসামগ্রী, গৃহনির্মাণের সামগ্রী ইত্যাদি নির্মাণে লোহার ব্যবহার করা হয়।
ব্যবহারিক জীবনে লোহা শিল্পের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। গুরুত্ব বিচারে বলা হয় ব্যবহারিক দিক হতে রুপার চেয়েও লোহা অধিক প্রয়োজনীয়। লোহা একটি দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে কাজ করে।
বিশ্বব্যাপী আকরিক লোহার উৎপাদন ও বণ্টন: পৃথিবীতে প্রায় ৩২,০১২ কোটি মেট্রিক টন আকরিক লোহা সঞ্চিত আছে বলে অনুমান করা হয়। এর অধিকাংশই (প্রায় ৯০%) চীন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কাজাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে অবস্থিত। নিচে পৃথিবীর আকরিক লোহার উৎপাদন ও বণ্টনের বিবরণ দেয়া হলোঃ
উৎপাদনকারী অঞ্চল:
এশিয়া: এ মহাদেশে পৃথিবীর প্রায় ৮% আকরিক লোহা উত্তোলিত হয়। এশিয়ার আকরিক লোহা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ভারতই প্রধান। এছাড়া মালয়েশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশেও আকরিক লোহা পাওয়া যায়।
১। চীন: আকরিক লোহা উৎপাদনে চীন বিশ্বে প্রথম। ২০১০ সালে এদেশে ৬৮৩ মিলিয়ন টন আকরিক লোহা উত্তোলিত হয়।. দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া, ইয়াং নদীর উপত্যকা, জোনান, হোপাই, সানটাং, সানবি, আনশান, লায়োনিং, হাঞ্চাউ, অন্তর্মঙ্গোলিয়া, সানসি, চিহ্বলি ও শান্টু-এ অধিকাংশ আকরিক লোহা পাওয়া যায়।
২। ভারত: আকরিক লোহা উৎপাদনে ভারত এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বে চতুর্থ। ২০১০ সালে এর উৎপাদন প্রায় ৭২ মিলিয়ন টন। এর খনিগুলো প্রধানত বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, গোয়া প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত। এদের মধ্যে উড়িষ্যার উৎপাদন সবচেয়ে বেশি (৩৬%) এবং এরপর বিহারের স্থান (২৬%)। তবে মধ্য প্রদেশের আকরিক লোহা (ঢালি ও রাজহারা) অত্যন্ত উৎকৃষ্ট শ্রেণির।
৩। জাপান : জাপান বিশ্বের অন্যতম লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ। বর্তমানে বিশ্বে লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। ২০১১ সালে এদেশের উৎপাদন ছিল ১০৮ মিলিয়ন টন। টোকিও, ইয়োকোহোমা, ওসাকা, কোমে, কামাইশী প্রভৃতি জাপানের উল্লেখযোগ্য লৌহ ও ইস্পাত কেন্দ্র।
৪। মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র: আকরিক লৌহ উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে তৃতীয়। ২০১১ সালে এদেশে ৮৬ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপাদন করে।
৫। রাশিয়া: আকরিক লোহা উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে রাশিয়ার স্থান পঞ্চম। ২০১০ সালে এদেশে ৬৯ মিলিয়ন টন আকরিক লোহা উত্তোলিত হয়। এটা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় ৮.০৬%। রাশিয়া ইউরাল ও মস্কো-টুলা অঞ্চল উৎকৃষ্টমানের আকরিক লোহার জন্য প্রসিদ্ধ।
- (ক) ইউরাল অঞ্চল: ইউরাল অঞ্চলের ম্যাগনিটোরস্ক এবং কুজনেৎস অঞ্চলে প্রধানত উৎকৃষ্ট শ্রেণির মা্যগনেটাইট জাতের লোহা পাওয়া যায়। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১০% লোহা এ অঞ্চল থেকে উত্তোলিত হয়।
- (খ) মস্কো-টুলা অঞ্চল: মস্কো-টুলা অঞ্চলে কুরস্ক (Kursk), ওরেল, ভোরোনেথ, ভলগোগ্রাড প্রভৃতি কেন্দ্রগুলো থেকে উৎকৃষ্টমানের আকরিক লোহা পাওয়া যায়।
অন্যান্য: এছাড়া অন্যান্য লোহার খনির অঞ্চলের মধ্যে উত্তরে কোলা উপদ্বীপের মুরমানস্ক, উত্তর-পশ্চিমে লেনিনগ্রাড, কুজবাস, বৈকাল হ্রদ অঞ্চল, ইনেসি ও আমুর নদীর অববাহিকা, ভ্লাসিভস্টক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৬। দক্ষিণ কোরিয়া: দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনকারী ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশ এবং বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে। ২০১১ সালে এদেশে ৬৮ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপন্ন হয়।
৭। জার্মানি: জার্মানি বিশ্বের সপ্তম লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ। ২০১১ সালে এদেশে ৪৪ মিলিয়ন লৌহ আকরিক উৎপন্ন হয়। ভাটমন্ড, এসেন, ভোসেল ডক, বোমাচ প্রভৃতি অঞ্চলে লৌহ ও ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছে।
৮। ইউক্রেন: আকরিক লৌহ উৎপাদনে ইউক্রেন বিশ্বে ৮ম অষ্টম। ২০১১ সালে এদেশে ৩৫ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপাদিত হয়। ইউক্রেনে ঝারাগান্ডার কয়লার সাহায্যে ম্যাগনিফোর্স-এ লৌহ ও ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছে।
৯। তুরস্ক: আকরিক লৌহ উৎপাদনে তুরস্ক বিশ্বের নবম স্থানের অধিকারী। ২০১১ সালে এদেশে ৩৪ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপাদিত হয়।
১০। ইতালি: ২০১১ সালে ইতালিতে ২৮ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপাদিত হয়।
১১। কানাডা : ২০১১ সালে এদেশে ১৩ মিলিয়ন টন আকরিক লৌহ উৎপাদিত হয়। সম্প্রতি লাব্রাডার ও পূর্ব কুইবেক সীমান্ত প্রচুর উচ্চ শ্রেণির হেমাটাইট (৬০%) লৌহ আকরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে।
১২। ব্রাজিল: লৌহ আকরিক উৎপাদনে বর্তমান বিশ্বে ব্রাজিল উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ২০১১ সালে ব্রাজিল ৩৫ মিলিয়ন টন লৌহ আকরিক উৎপাদন করে। ব্রাজিলের লৌহ আকরিক উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো হলো- বিলোহাটি, জোমাট, মটোগ্রামো, বেরিনা প্রভৃতি।
অন্যান্য দেশ: উপরের দেশগুলো ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন, বেলজিয়াম, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, মরক্কো প্রভৃতি দেশ আকরিক লৌহ উৎপাদন করে থাকে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য (International trade): পৃথিবীর সব দেশেরই লোহার প্রয়োজন আছে। এজন্য আকরিক লোহার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অত্যন্ত বিস্তৃত ও গুরুত্বপূর্ণ। আকরিক লোহা আমদানি করে বিভিন্ন শিল্পোন্নতশীল দেশ, রপ্তানি করে লোহা শিল্পে অনুন্নত দেশ অথবা যারা প্রয়োজনাতিরিক্ত লোহা উৎপন্ন করে।
রপ্তানিকারক দেশসমূহ: আকরিক লোহা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, ইউক্রেন, সুইডেন, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, স্পেন, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি প্রধান।
আমদানিকারক দেশসমূহ: আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে জাপান, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার:
সভ্যতার সূচনা হয় আকরিক লোহার মাধ্যমে। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার ভিত্তি হলো আকরিক লোহা। সুতরাং এ কথা বলা যায় কোনো দেশের কৃষি, শিল্প, পরিবহন, ব্যবসায়-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক উন্নতি আকরিক লোহার উপর নির্ভরশীল। এ কারণে আকরিক লোহা উৎপাদনে প্রসিদ্ধ দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট উন্নত।
আরো পড়ুনঃ প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও বণ্টনের বিবরণ দাও।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। লোহার গুরুত্ব কী? পৃথিবীর প্রধান প্রধান লোহা উৎপাদনকারী দেশের বর্ণনা কর এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url