ভূত্বক ও পৃথিবীর গঠন এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে ভূত্বক ও পৃথিবীর গঠন এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে আলোচনা করব।
পৃথিবীর গঠন
আমাদের এ পৃথিবী বিশাল সৌরজগতের একটি অংশবিশেষ। লক্ষ লক্ষ সৌরজগৎ একত্রে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে ছায়াপাত। আবার লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি মিলিত হয়ে গঠিত হয়েছে বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। যা সত্যি আমাদের ধারণার বাইরে। সৌরজগতের তৃতীয় নিকটতম গ্রহ পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় ছিল একটি জ্বলন্ত বাষ্পপিণ্ড।
পরবর্তীতে এ বাষ্পপিগুটি আস্তে আস্তে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। সে সময় এতে নানা জাতীয় যেমন- লৌহ, নিকেল প্রভৃতি ধাতুর গ্যাস, লবণজাতীয় পদার্থের গ্যাস, জলীয়বাষ্প মিশ্রিত ছিল। লক্ষ করা যায় হালকা গ্যাস উপরের দিকে, লবণজাতীয় গ্যাস মাঝের দিকে এবং একেবারে ভিতরের দিকে লৌহজাতীয় পদার্থের গ্যাসের সমন্বয়ে তিনটি স্তরে বিভক্ত হয়েছে। সে তিনটি স্তর যথাক্রমে অশ্মমণ্ডল, গুরুমণ্ডল এবং কেন্দ্রমণ্ডল নামে পরিচিত।
ভূত্বক ও পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন
সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী সূর্যের ন্যায় একটি জ্বলন্ত বাষ্পপিও ছিল। কোটি কোটি বছরের ঘূর্ণনের ফলে এটি তাপ বিকিরণ করে ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। কালক্রমে বাষ্পীয় অবস্থা হতে প্রথমে তরল পরে ক্রমশ শীতল ও ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর চারপাশে এক কঠিন আবরণের সৃষ্টি করে।
যাকে আমরা ভূত্বক বলে থাকি। বাষ্পীয় পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে ধীরে ধীরে তার পৃষ্ঠদেশে প্রথমে পাতলা স্তরের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এ স্তর পুরু হয়ে ভূত্বকের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ভূত্বকের নিম্নাংশ এখনও উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সাধারণত দেখা যায় ভূগর্তে প্রতি ৫০/৬০ ফুট নিচের দিকে ১০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
সুতরাং পৃথিবীর পৃষ্ঠ হতে ১৬ কি.মি. নিচে যে উত্তাপ আছে তাতে কোনো পদার্থ সম্পূর্ণ কঠিন অবস্থায় থাকতে পারে না। মানুষ যতবেশি পৃথিবীর অভ্যন্তরে গিয়েছে ততবেশি উত্তাপ অনুভব করেছে। তাছাড়াও উষ্ণ প্রস্রবণ ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় দেখা গেছে যে, পৃথিবীর অভ্যন্তর হতে আগত পদার্থসমূহ খুবই উষ্ণ। তাতে বিজ্ঞানিগণ অনুমান করেন যে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তাপ প্রায় ৬০০০° সেন্টিগ্রেড।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভূত্বক পর্যন্ত অংশকে বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানিগণ তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যা নিম্নরূপ:
১) অশ্মমণ্ডল (Lithosphere): ভূপৃষ্ঠের নানা প্রকার শিলা দ্বারা গঠিত কঠিন বহিরাবরণকে অশ্যমণ্ডল বলে। 'অশ্ম' শব্দের অর্থ হলো শিলা। যে কারণে এ মণ্ডলকে শিলামণ্ডলও বলা হয়। এ মণ্ডলের গভীরতা ৩ কি.মি. হতে ৪০ কি.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। গড় গভীরতা ২০ কি.মি.।
এ স্তরের আপেক্ষিক গুরুত্ব পানির চেয়ে ২/৩ গুণ ভারী। এ শিলামণ্ডল সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, কোয়ার্টজ, ফেলসপার, গ্রানাইট ও কিছু ব্যাসল্ট উপাদান দ্বারা গঠিত। অশ্মমণ্ডলের নিচের দিকে প্রতি কিলোমিটারে ৩০° সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ স্তরটি দুটি স্তরে বিভক্ত। উপরের স্তরটি হালকা। এ স্তরকে সিয়াল স্তর বলে। নিচের স্তরটি ভারী। এ স্তরকে সিমা স্তর বলে।
(ক) সিয়াল স্তর : অশ্বামণ্ডলের বাইরের স্তর হলো সিয়াল স্তর। এ স্তরে গ্রানাইট জাতীয় শিলার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। গ্রানাইট শিলায় সিলিকন (Silicon) ও অ্যালুমিনিয়ামের (Aluminium) পরিমাণ বেশি। সিলিকন থেকে (Si) এবং অ্যালুমিনিয়াম থেকে (AI) এর সমন্বয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী সুয়েস (Suess) এ স্তরকে 'সিয়াল' (SIAL) স্তর বলে অভিহিত করেছেন।
(খ) সিমা স্তর: অশ্মমণ্ডলের নিচের স্তর অর্থাৎ মহাদেশগুলোর তলদেশ ব্যাসল্ট শিলা দ্বারা গঠিত। ব্যাসল্ট শিলায় সিলিকন (Silicon) এবং ম্যাগনেসিয়ামের (Magnesium) পরিমাণ বেশি থাকে। তাই ভূবিজ্ঞানী সুয়েস এ স্তরকে 'সিমা' (SIMA) স্তর বলে অভিহিত করেছেন। সিমা স্তরের উপরের অংশে ক্ষারীয় এবং নিচের অংশে অতি ক্ষারীয় শিলা বিদ্যমান। জেফরীজ ক্ষারীয় অংশটিকে মধ্যস্তর এবং নিচের অতি ক্ষারীয় অংশটিকে নিম্নস্তর বা অন্তস্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২) গুরুমণ্ডল (Mantle or Barysphere): অশ্মমণ্ডলের পরের স্তরটিকে গুরুমণ্ডল বলে। গুরুমণ্ডলের শুরু থেকে কেন্দ্রমণ্ডল পর্যন্ত এ স্তরের বিস্তৃতি প্রায় ২,৮৮৫ কিলোমিটার। এ স্তরের ঊর্ধ্বাংশের শিলা কঠিন ও ভঙ্গুর। যার বিস্তৃতি ১০০ কি.মি. পর্যন্ত। এ স্তরটির ১০০ কি.মি. গভীরতায় তাপমাত্রা ১১০০০ - ১২০০° সেলসিয়াস এবং ৭০০ কি.মি. গভীরতায় ১৯০০° সেলসিয়াস বলে ধারণা করা হয়। তবে এর নিচের অংশের তাপমাত্রা প্রায় ৩,০০০° সেলসিয়াসের বেশি।
গুরুমণ্ডলের উপরের অংশে ঘনত্বের চাপ ২৬০ কিলোবার, নিচের অংশের ঘনত্বের চাপ ১,৩৫০ কিলোবার এবং গড় চাপ ৮৮৫ কিলোবার। ভূত্বক এবং গুরুমণ্ডলের মাঝামাঝি অংশ বরাবর একটি পাতলা স্তর রয়েছে যাকে মোহোবিচ্ছেদ বলা হয়। এ স্তর গঠনকারী উপাদানগুলো কঠিন ও চটচটে অবস্থায় রয়েছে। গঠনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে গুরুমণ্ডলকে দুই ভাগে ভাগ কর যায়। যথা- (ক) বহিঃগুরুমণ্ডল ও (খ) অন্তঃগুরুমণ্ডল।
(ক) বহিঃগুরুমণ্ডল: গুরুমণ্ডলের উপরের অংশকে বহিঃগুরুমণ্ডল বলে। এ স্তরটি ক্রোমিয়াম (Cro), লোহা (Fe), সিলিকন (Si) ও ম্যাগনেসিয়াম (Ma) উপাদান দ্বারা গঠিত। তাই এ স্তরকে সংক্ষেপে ক্রোফেসিমা (Cro-Fe-Si-Ma) বলা হয়। এ মণ্ডলের শিলাসমূহের তাপ গলনাঙ্কের কাছাকাছি। যে কারণে এ স্তরটি বেশ নরম অবস্থায় থাকে। তাই এ স্তরটিকে নমনীয় স্তর বলা হয়।
এটি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার গভীর। নমনীয়মণ্ডলের শিলাসমূহ আংশিক নরম অবস্থায় থাকার কারণে ভূঅভ্যন্তরের বেশিরভাগ আলোড়ন এ স্তর থেকে উৎপত্তি হয়। প্রধানত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এ স্তর থেকেই হয়ে থাকে। এ মণ্ডলটি আবার ব্যাসল্ট জাতীয় উপাদানে গঠিত বলে একে ব্যাসল্ট অঞ্চলও বলা হয়ে থাকে। এটি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এ মণ্ডলে প্রচণ্ড তাপের জন্য যে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয় তার ফলে এর ওপর ভাসমান মহাদেশগুলো চলমান অবস্থায় থাকে। এতে ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।
(খ) অন্তঃগুরুমণ্ডল: গুরুমণ্ডলের নিচের দিকে ৭০০ কিলোমিটার থেকে ২,৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলকে অন্তঃগুরুমণ্ডল বলে। এ স্তরটি প্রধানত নিকেল (Ni), লোহা (Fe), সিলিকা (Si) ও ম্যাগনেসিয়াম (Mg) দ্বারা গঠিত। যে কারণে এ স্তরকে সংক্ষেপে নিফেসিমা (Ni-Fe-Si-Ma) বলে। এ মণ্ডলের ঘনত্ব ৫.৫ থেকে ১০। ভূবিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন এ মণ্ডলটি বর্তমানেও বেশ উত্তপ্ত অবস্থায় আছে।
গুরুমণ্ডল ও অশ্মমণ্ডলের মধ্যে একটি পাতলা স্তর আছে। এ স্তরটি আবিষ্কার করেন ১৯০৯ সালে যুগোশ্লাভিয়ার ভূকম্পনবিদ মোহোরোভিসিক। মোহোরোভিসিকের নামানুসারে এ স্তরটিকে বলা হয় মোহোবিযুক্তিরেখা। আবার গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমন্ডলের যে সংযোগস্থল সে সংযোগস্থলকে ভূবিজ্ঞানী গুটেনবার্গ-এর নাম অনুসারে একে গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখা (Gutenberg Discontinuity) বলে।
৩) কেন্দ্রমণ্ডল: পৃথিবীর কেন্দ্রে এর অবস্থান। অর্থাৎ গুরুমণ্ডলের নিচের থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত মণ্ডলটিকে কেন্দ্রমণ্ডল বলে। কেন্দ্রমণ্ডলটি নিকেল (Ni) এবং লোহা (Fe) প্রধান উপাদান বলে ভূবিজ্ঞানী সুয়েস এর নাম দিয়েছেন নাইফ (NiFe)। আবার ভূবিদ আর্থার হোমস একে 'অন্তস্থল' নামে অভিহিত করেছেন।
গুটেনবার্গ বিযুক্তি থেকে এ মণ্ডলের গভীরতা ৩,৪৮৬ কিলোমিটার। এ মণ্ডলটি পৃথিবীর মোট আয়তনের শতকরা প্রায় 4 ১৬.২ ভাগ স্থান দখল করে আছে। এর ওজন পৃথিবীর মোট ওজনের শতকরা ৩১.৫ ভাগ। আপেক্ষিক গুরুত্ব ১০ হতে ১৩.৬। এ মণ্ডলটি পানি অপেক্ষা ১০/১২ গুণ এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশ অপেক্ষা দ্বিগুণেরও বেশি ঘন।
ধারণা করা হয়, এ মণ্ডলটির কাঠামো স্থিতিস্থাপক ও চটচটে অবস্থায় আছে। কেন্দ্রমণ্ডলের তাপমাত্রা স্থানভেদে ৩০০০° থেকে ৫০০০° সে. বা তারও বেশি। এর ঘনত্বের চাপ নিচের অংশে ৩,৭০০ কিলোেবার এবং উপরের অংশে ৩৩৪০ কিলোবার। গড় চাপের পরিমাণ ৩,৬৮০ কিলোবার। ভূকম্পন তরঙ্গের তত্ত্বের ভিত্তিতে কেন্দ্রমণ্ডলকে দুটি অংশে বিভক্ত করা যায়। যথা- (ক) বহিঃকেন্দ্র বা বাইরের অংশ এবং (খ) অন্তঃকেন্দ্র বা ভিতরের অংশ।
(ক) বহিঃকেন্দ্র: ভূবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন বহিঃকেন্দ্র তরল অবস্থায় রয়েছে। এর বিস্তৃতি প্রায় ২২৭০ কিলোমিটার। তরল অবস্থায় থাকার কারণে বহিঃকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে ভূমিকম্পের P-তরঙ্গ (অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ) ধীরগতিতে প্রবাহিত হয় এবং ১ তরঙ্গ (তির্যক তরঙ্গ) প্রবেশ করতে পারে না।
(খ) অন্তঃকেন্দ্র: পৃথিবীর কেন্দ্র হতে প্রায় ১,২১৬ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অন্তঃকেন্দ্রমণ্ডলের অবস্থান। ভূবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন অন্তঃকেন্দ্র কঠিন অবস্থায় আছে। এটি প্রধানত লোহা ও নিকেল দ্বারা গঠিত। এর আপেক্ষিক গুরুত্ব ১৩.৬।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। ভূত্বক ও পৃথিবীর গঠন এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url