পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব।
পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক (Relationship of Civics & Good Governance with Economics) পৌরনীতি ও সুশাসন মূলত একটি সামাজিক বিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাই একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ সূত্র ধরেই সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা অর্থনীতির সাথে পৌরনীতি ও সুশাসনের সম্পর্ক নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। নিচে এ দুটি সামাজিক বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হলো:
ক. পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবজীবনের কল্যাণ সাধন উভয় বিজ্ঞানেরই উদ্দেশ্য। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে শিক্ষা দেয়। পক্ষান্তরে, অর্থনীতি নাগরিকদের অর্থ উপার্জন, অর্থ ব্যয় এবং সীমিত অর্থে কীভাবে বহুবিধ চাহিদা পূরণ করতে হয় সে সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।
অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ (Adam Smith) এর মতে, 'অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান করে।' অধ্যাপক মার্শাল বলেন, 'অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে। অর্থনীতিবিদ Bober-এর ভাষায়, 'Economics can be briefly defined as the study of the administration of scares resource and the determinants of employment and income." আর.এম. ম্যাকাইভার তার 'Web of Government' গ্রন্থে বলেছেন, 'সব রকমের শাসন পদ্ধতি তার অনুরূপ সম্পত্তি ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে।
একটির পরিবর্তন হলে অন্যটিরও পরিবর্তন সাধিত হয়।' অধ্যাপক এল রবিনস (Prof. L. Robbins) অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, 'অর্থনীতি মানুষের চরম উদ্দেশ্য এবং পরিবর্তক ব্যবহারযুক্ত সসীম সম্পদের ভিতর সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি আলোচনা করে। (Economics is a science which studies human behaviour is a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.) পৌরনীতি ও সুশাসন কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায় এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে সুষ্ঠুরূপে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ করতে চায়। আর অর্থনীতি অর্থ আয় ও ব্যয়ের যথাযথ উপায় সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করে মানবকল্যাণ সাধনে আগ্রহী।
খ. পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির মধ্যে যে কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান তা নয়, উভয়ই পরস্পর নির্ভরশীল এবং পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমান রাষ্ট্র আর 'পুলিশি রাষ্ট্র' (Police State) নয়, রাষ্ট্র এখন 'কল্যাণমূলক' (Welfare State) প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রকে নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। নাগরিকদের রাজনৈতিক জীবন অর্থনীতির দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত। সরকারের সাফল্য নির্ভর করে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের উপর।
আবার অন্যদিকে, সরকারের উপর যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালনার ভার ন্যস্ত থাকে। কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই (Economic plan) রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহানুভূতি ব্যতীত কার্যকর হতে পারে না। তাছাড়া শিল্প, বাণিজ্য, উৎপাদন, বণ্টন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। আধুনিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল বিধায় এক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ একান্ত আবশ্যক। সরকারকে উৎপাদনের পরিমাণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হয়।
গ. সুশাসনের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জবাবদিহিতা। কোনো রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা না থাকলে সে দেশের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন দক্ষ হয় না। নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন দক্ষ না হলে বেসরকারি সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে সে দেশে বেসরকারি সংস্থাগুলোর বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অর্থনীতি চরম হুমকির মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ সুশাসনের সাথে অর্থনীতি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
ঘ. সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে সকল দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয় তন্মধ্যে অন্যতম হলো- দুর্বল সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতের অপর্যাপ্ত আইনি কাঠামো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, দুর্বল বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কাঠামো, দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ দুর্বলতাসমূহ দূর করা আবশ্যক। অথচ এ সমস্যাগুলো দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন অর্থনীতি সম্পর্কিত যথেষ্ট জ্ঞান।
অর্থাৎ, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির গভীর যোগসূত্র রয়েছে। সমাজে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যেমন জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন অর্থনৈতিক জ্ঞান ও দক্ষতার। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার জন্য প্রয়োজন যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দক্ষতা ও দূরদর্শিতা। তাই বলা যায়, সুশাসন প্রশ্নে পৌরনীতি ও অর্থনীতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ।
পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক থাকলেও বিষয় দুটি স্বতন্ত্র। পৌরনীতি ও সুশাসনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো নাগরিকতা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ। আর অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কার্যাবলি। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য, নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্র, সরকার, গভর্নেন্স প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু অর্থনীতি অভাব, চাহিদা, উৎপাদন, বণ্টন, মুদ্রা, ব্যাংক ব্যবস্থা, জাতীয় আয়, কর, শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। পৌরনীতি ও সুশাসনের অধ্যয়ন পদ্ধতি মূলত ঐতিহাসিক কিন্তু অর্থনীতির অনুশীলন পদ্ধতি গণিতনির্ভর। পৌরনীতি ও সুশাসন অনেকটা নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞান, আর অর্থনীতি মূলত বস্তুনিষ্ঠ মাত্র।
আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। জনগণের সর্বাধিক মজাল সাধনই উভয়ের উদ্দেশ্য।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url