সুশাসনের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে সুশাসনের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা করব।
সুশাসনের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (Legal and Institutional Structure of Good Governance), গত শতকের নব্বই দশকের প্রারম্ভে রাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামোকে জনগণের জন্য আরও কল্যাণকর করে তোলার লক্ষ্যে 'সুশাসন' প্রত্যয়টির প্রচলন ও এ বিষয়ে উদ্যোগের সূচনা হয়। সুশাসন হচ্ছে দায়িত্বশীল, অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও ন্যায়ানুগ শাসনের প্রক্রিয়া।
আইনের শাসন এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আর রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সহায়ক আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এ ধরনের কাঠামো কল্যাণকর শাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক। নিচে সুশাসনের প্রয়োজনীয় শর্তগুলো আলোচনা করা হলো-
১. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক হয়। এ শাসনব্যবস্থার সব স্তরই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটে। জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর জনগণের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এতে জনকল্যাণের বিষয়টি গুরুত্ব পায় যা সুশাসনের প্রধান লক্ষ্য। তাই সুশাসনের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন।
২. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি: গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস জনগণ। জনগণের ক্ষমতার এই স্বীকৃতি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাণস্বরূপ। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আবশ্যক।
৩. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: আইনের শাসন ছাড়া রাষ্ট্রে স্বেচ্ছাচারিতা বিরাজ করে। অন্যদিকে আইনের অনুশাসন রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হতে দেয় না, নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে, নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এজন্য আইনের শাসন সুশাসন প্রতিষ্ঠার এক অপরিহার্য উপাদান।
৪. ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ: সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থেকে দায়িত্ব পালন করার নীতিই হলো ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি। এর ফলে প্রত্যেক বিভাগই অন্যের হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সুশাসনের জন্য ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ সহায়ক।
৫. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা সরকারকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। জনগণ শাসন কাজে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাই সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন।
৬. আইন বিভাগের কার্যকর ভূমিকা: আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন ও শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ বিভাগের সুবিবেচনাপ্রসূত আইন উত্তম শাসনের নিশ্চয়তা দেয়। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করায় আইন বিভাগের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সুশাসনের জন্য কার্যকর আইন বিভাগের উপস্থিতি আবশ্যক।
৭. স্বাধীন বিচার বিভাগ: বিচার বিভাগ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের রক্ষক ও অভিভাবক। আইন ও শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
৮. শাসন বিভাগের দায়বদ্ধতা: রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণের কাছে শাসন বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা দায়বদ্ধতা থাকলে শাসন বিভাগ জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো কাজ করতে পারে না।
৯. মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি: মৌলিক অধিকার ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করে। মৌলিক অধিকার ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হলে তা সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিভিন্ন মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
১০. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া সুশাসন চিন্তা করা যায় না। গণমাধ্যম স্বাধীন থাকলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকে। তাই জনমতের প্রতি সংবেদনশীল সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকতে হবে।
১১. নিয়ন্ত্রিত, সাড়াদানকারী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র: সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন, জনগণের চাহিদার প্রতি দ্রুত সাড়াদানকারী দক্ষ আমলাতন্ত্র। এ ধরনের আমলাতন্ত্রই জনগণকে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করে উত্তম শাসন নিশ্চিত করতে পারে।
১২. কার্যকর গণতান্ত্রিক দলব্যবস্থা: দলব্যবস্থা গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। বহুদলীয় ব্যবস্থা বহু মতের প্রকাশ ও সমন্বয়। করে। দলব্যবস্থা সরকারের ভূমিকাকে গণমুখী করায় ভূমিকা রাখে। জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। দলব্যবস্থার কার্যকর ভূমিকা ছাড়া সুশাসন চিন্তা করা যায় না।
১৩. দুর্নীতি দমনের সহায়ক প্রতিষ্ঠান: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্নীতি সুশাসন ও উন্নয়নের একটি বিরাট অন্তরায়। দুর্নীতিকে সুশাসনের প্রধান বাধা হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। দুর্নীতি দমনের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকা আবশ্যক। এ সব প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি খাতের দুর্নীতি সম্পর্কে তদন্ত, গবেষণা ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করে।
১৪. ন্যায়পাল: সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও আমলাদের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ন্যায়পালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতিমুক্ত, কার্যকর ও দক্ষ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ন্যায়পাল ভূমিকা রাখে। ন্যায়পালের উপস্থিতি জনকল্যাণমূলক শাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক। সুতরাং সুশাসনের জন্য ন্যায়পালের উপস্থিতি আবশ্যক।
১৫. সক্রিয় সুশীল সমাজ: সুশীল সমাজের সক্রিয় ভূমিকা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। সুশীল সমাজ স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার ভূমিকা রাখে, সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমে জনগণকে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করে। এছাড়া সরকারের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধিতে নাগরিক সমাজের সক্রিয় উপস্থিতি বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই কমবেশি লক্ষ করা যায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে শাসনকে কল্যাণকামী করতে সুশীল সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বৈধ সরকার এবং দক্ষ, সমতাভিত্তিক ও প্রযুক্তিমুখী দূরদর্শী শাসন প্রয়োজন। উল্লিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে সুশাসনের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে উঠবে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। সুশাসনের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url