সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব

সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব

সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব (Importance to establish Good Governance), আইনের শাসন, দায়িত্বশীল সরকার ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। সুশাসনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়। সুশাসনের মাধ্যমেই একটি সমাজ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সুশাসন হলো একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়। UNDP এর মতে- 'কেবল সুশাসনের মাধ্যমেই নাগরিকদের আগ্রহ বা আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, অধিকার ভোগ এবং চাহিদাপূরণ সম্ভব।

২. বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পদগুলোর টেকসই উন্নয়ন ঘটে। ফরাসি অর্থনীতিবিদ এবং প্রশাসক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক মহাপরিচালক, সুশাসন বিষয়ক তাত্ত্বিক মিশেল ক্যামডেসাস (Michel Camdessus) সুশাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বের ক্ষেত্রে এক বাক্যে বলেন, 'রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক।

৩. নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের লক্ষ্যে সব নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক। সুশাসন রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে।

৪. সহনশীলতাসহ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

৫. সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নয়, প্রকৃতপড়ো রাষ্ট্রের সব দিক ও পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক। শোষণমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন, সামাজিক সুবিচার, নারীর অধিকার ও সম্পদের সুষম-বণ্টন প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক মানবাধিকার ও মানবসত্তার মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য সুশাসন প্রয়োজন। সার্বিকভাবে বলা যায়, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সুশাসন।

৬. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশাসনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

৭. সুশাসনের অনুপস্থিতিতে সরকারি সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থি নীতি নির্ধারণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সেই সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বেসরকারি খাতের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাবের অভাব দেখা যায়।

৮. সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতি রোধ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে।

৯. ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত জি-৮ সম্মেলনে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য যে কৌশলপত্র নির্ধারণ করা হয় তাতে বলা হয়, 'সাহায্য তখনই কার্যকর হবে যখন সরকারের দৃঢ় নীতিমালা থাকে, থাকে নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সম্পদ আহরণের সক্ষমতা। আর এর জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা'। অর্থাৎ এখানে পরোক্ষভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়।

১০. বর্তমানে বিভিন্ন দেশের দাতা সংস্থাগুলো উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের ওপর জোর দিচ্ছে। জাতিসংঘের আফ্রিকা অঞ্চলের বিশেষ উপদেষ্টা ইব্রাহিম আগবোলা গামবারি (Ibrahim Agboola Gambari) বলেন- 'যে সমস্ত দেশে সুশাসন আছে কেবল সে সমস্ত দেশেই ঋণ মওকুফ করা হবে।

১১. সুশাসন না থাকলে সমাজ এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কুশাসনের চক্রে পড়ে গেলে সুশাসন সুদূরপরাহত হয়ে দাঁড়ায়। বিশৃংখলা চরমে উঠলে কোনো কোনো রাষ্ট্রের ভাগ্যে এমনকী 'ব্যর্থ রাষ্ট্রের' তকমাও জোটে।

১২. যে রাষ্ট্রে সুশাসন বিদ্যমান থাকে সেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিজেকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে করে। সে বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা রাখা দরকার। এভাবে জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

১৩. সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি নিজেদের শাসন প্রক্রিয়ার বাইরের অংশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখা নিষ্প্রয়োজন মনে করে তাহলে সে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর জবাবদিহিতা কমে যায়। ফলে দুর্নীতির দ্বার উন্মোচিত হয়। এভাবে একপর্যায়ে শাসন কাঠামো প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সামরিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনে এ ধরনের অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।

উল্লিখিত আলোচনায় সুশাসনের তাত্ত্বিক দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। প্রায়োগিক দিক থেকে বলা যায়, জবাবদিহিমূলক, কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা, নাগরিকের জীবনমান উন্নত করা, তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ় করা, সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

0/Post a Comment/Comments