সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব (Importance of Good Governance in Social Field), আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সুশাসনের গুরুত্ব ক্রমশ বেড়েই চলছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য। নিম্নে সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা: নাগরিক জীবনের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষের জন্য রাষ্ট্রকে যে সব অধিকার সংরক্ষণ করতে হয় সেগুলো হলো সামাজিক অধিকার। জীবনধারণ, চলাফেরা, সম্পত্তি ভোগ, চুক্তি করা, মতামত প্রকাশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি হলো সামাজিক অধিকার। কোনো রাষ্ট্রে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে এ সামাজিক অধিকারগুলো বিপন্ন হয়।
২. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: দুস্থ, দরিদ্র, অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনমানের নিশ্চয়তার বিষয়টি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শারীরিক প্রতিবন্ধী, এতিম, দুস্থ, বয়স্ক, বিধবা, দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা সুশাসনের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়।
দুর্বল শাসনব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দায়িত্বশীল এবং পক্ষপাতহীন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কেবল সুশাসনেই সম্ভব। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রাষ্ট্র থেকে গৃহীত হলেও যদি সুশাসন নিশ্চিত না হয় তবে অতি দরিদ্র নাগরিকরা সে সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।
৩. দারিদ্র্য বিমোচন: সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রথমত প্রয়োজন দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাসকারীদের চিহ্নিতকরণ, কৌশল নির্ধারণ এবং নির্ধারিত কৌশল অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দক্ষ কৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। বিশেষ করে দারিদ্র্যের আওতায় থাকা জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থান বিবেচনা করে কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজন হয়। যে সব সংস্থা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছে তারা দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতি গুরুত্বারোপ করছে।
৪. সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা: একটি জাতির ইতিহাস, সভ্যতা, জাতীয় চরিত্র ও পরিচিতি সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গোঁড়ামি, কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার পরিহার এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের লালন। বিষয়টি কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব।
৫. সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ: সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, অন্যায়-অত্যাচার-ব্যভিচার বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে যাত্রা করে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে কার্যক্রম গ্রহণ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
৬. নারী উন্নয়ন: নারীদের শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতায়ন সুশাসন প্রতিষ্ঠা দ্বারা সম্ভব। সুশাসনে সাম্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নাগরিক হিসেবে পুরুষ বা নারী প্রত্যেকেই যাতে সকল ক্ষেত্রে সম অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে সুশাসন। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে নারীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা বজায় থাকবে যা নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকারের ধারণার বিপরীত।
৭. শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণ: শিক্ষা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রান্তিক পর্যায়ের নাগরিকদেরও শিক্ষার সুযোগের আওতায় আনা, যুগোপযোগী কারিকুলাম ও সিলেবাস, শিক্ষা উপকরণের সহজলভ্যতা, যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ প্রভৃতি বিষয়ের মাধ্যমে নাগরিকের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়। আর এসব বিষয় কার্যকরের জন্য প্রয়োজন সুশাসন।
৮. স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ: চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, গড় আয় বৃদ্ধিকরণ, পুষ্টির যোগান, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, প্রয়োজনীয় ও মানসম্মত ওষুধ সরবরাহ, চিকিৎসা সেবার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও জনবল, চিকিৎসা বিজ্ঞান শেখার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান (হাসপাতাল, ক্লিনিক) প্রভৃতি নাগরিকের স্বাস্থ্য অধিকারের সাথে সম্পর্কিত। এ বিষয়গুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
৯. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমে নাগরিকের মতামত প্রকাশের পথ সুগম হয়। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সরকারি বিজ্ঞাপন ও কাগজ বরাদ্দের মাধ্যমে সংবাদপত্রকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ও বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা গণমাধ্যমের বিকাশকে ব্যাহত করে।
একমাত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অর্থ সবকিছু রিপোর্টিং করার স্বাধীনতা নয় বরং জনস্বার্থের বিষয়গুলো তুলে ধরাই মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া সুশাসন বাস্তব রূপ লাভ করে না বরং শুধু তত্ত্বের পর্যায়েই থেকে যায়। গণমাধ্যম অত্যন্ত সফলভাবে যে কোনো বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে। অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০. সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি: একটি রাষ্ট্রের ও সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক সংহতি ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সামাজিক সংহতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুশিক্ষা ইত্যাদি। সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির শর্তগুলো সুশাসনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব।
১১. পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ: বর্তমান পৃথিবীর জন্য একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। পরিবেশ-প্রতিবেশের এমন পরিবর্তন লাগামহীনভাবে চলতে থাকলে মানুষের অস্তিত্বও একসময় বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। জলবায়ু, পরিবেশ ইত্যাদির বিকৃতি এখনই মানুষের জীবনধারণকে কঠিন করে তুলেছে।
নতুন নতুন প্রাণঘাতী রোগের প্রাদুর্ভাব, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের ফলন হ্রাস, বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস ও অবাঞ্ছিত বস্তুকণার পরিমাণ বৃদ্ধি মানুষের অস্তিত্বের ওপর আজ সরাসরি আঘাত হানছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। একমাত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভব।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। সামাজিক ক্ষেত্রে সুশাসনের গুরুত্ব এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url