আইনের ধারণা - Concept of Law
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে আইনের ধারণা - Concept of Law নিয়ে আলোচনা করব।
সামাজিক জীব বলে মানুষকে সমাজের রীতিনীতি ও নিয়মের প্রতি অনুগত থাকতে হয়। এই আনুগত্যই সুশৃঙ্খল জীবন নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রীয় জীবনের উন্নতি ও সুশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান প্রণীত হয়। সৃষ্টি হয় আইন।
ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আমরা আইনের সাথে জড়িত। আর আইনের মূল কথা হলো আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সকলে মিলে যাতে শান্তিতে বসবাস করা যায় সেটিই হলো আইনের লক্ষ্য। তাহলে কেউ কারও অধিকার ও স্বাধীনতাকে খর্ব করবে না এবং আইনও অমান্য করবে না।
'আইন' বলতে সামাজিক আইন, নৈতিক আইন, প্রাকৃতিক আইন প্রভৃতিকে বোঝায়। নাগরিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি হলো পৌরনীতি ও সুশাসনের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত নিয়ম- কানুনকেই রাষ্ট্রীয় আইন বলা হয়।
রাষ্ট্রীয় আইনের পেছনে কোনো ঐশ্বরিক শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। তাছাড়া অন্যান্য আইনের সাথে রাষ্ট্রীয় আইনের মৌলিক পার্থক্য হলো সর্বপ্রকার আইনের মধ্যে কেবল রাষ্ট্রীয় আইন সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক প্রণীত ও প্রযুক্ত হয়। এ আলোচনার দ্বারা এটি বলা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসনে সংকীর্ণ অর্থে আইন শব্দটি প্রয়োগ করা হয়।
আইন একটি ফারসি শব্দ। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Law'-এর উৎপত্তি টিউটনিক শব্দ 'Lag' থেকে। 'Law' শব্দের অর্থ 'স্থির' বা 'অপরিবর্তনীয়' এবং এটি সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে আইনকে ব্যাখ্যা করেছেন। জন অস্টিন (John Austin)-এর কথায়, 'সার্বভৌম শাসকের আদেশই আইন।
(Law is the command of the sovereign.) অধ্যাপক হল্যান্ড (Professor Holland) আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, 'রাজনৈতিক সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই আইন।' (A law is a general rule of external action enforced by the sovereign political authority.)
স্যার হেনরি মেইন (Sir Henry Maine) জন অস্টিন ও অধ্যাপক হল্যান্ডের আইনের সংজ্ঞা দুটিকে সমালোচনা করে বলেছেন - 'সার্বভৌম শক্তির খেয়ালখুশি হতে উদ্ভূত অনুশাসনকে আইন বলা যায় না বরং পরিবর্তনশীল, ক্রমবর্ধমান সামাজিক প্রথার যোগফলকে বলা হয় আইন।
আইনের সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson)। তার মতে-'সমাজের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও রীতি-নীতির যে অংশটুকু স্পষ্ট এবং মৌলিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এবং সরকারের সমর্থন লাভ করে সুসংঘবদ্ধ বিধি-বিধানের রূপ লাভ করেছে তাই আইন।
(Law is that portion of the established thought and habit which has formed a distinct and formal recognition in the shape of uniform rules backed by the authority and power of the state.) এ সংজ্ঞার বিশ্লেষণ হতে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আইন বিভিন্ন প্রথা, রীতি-নীতি ও সরকারের স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
অধ্যাপক গেটেল (Prof. Raymond Garfield. Gettell) বলেন-'রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম-কানুন তৈরি করে, অনুমোদন দেয় এবং প্রয়োগ করে সেগুলোই আইনে পরিণত হয়।' (Only those rules which the state creats of which it recognized and enforced become laws.) দার্শনিক থমাস হবস (Thomas Hobbes) এর মতে-'প্রজাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আদেশই আইন।
(The civil law is the command of him which indowed with supreme power in the state concerning the future actions of his subjects.) গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, 'আইন হলো আবেগবর্জিত যুক্তি।' (Law is the passionless reason). বার্কার (Barker) মনে করেন-'কেবল সরকারের স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বিষয়গুলোকে আইন বলা সঙ্গত নয়।
আইনের মধ্যে বৈধতা (Legal Sanction) এবং নৈতিক মূল্য থাকা প্রয়োজন। আইন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করে। এটি সমাজবদ্ধ মানুষের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পথ প্রশস্ত করে। বস্তুত আইন সর্বজনীন ও সর্বগ্রাহী। আইন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিচে আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো-
- সমাজে বসবাসকারী সকলকেই আইন মেনে চলতে হয়। আইন ছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই আইনের কোনো বিকল্প নেই।
- আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। আইনের অনুশাসন কারও পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আইনের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ করা হয় না। ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বংশ, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে আইনে কোনো তারতম্য করা হয় না।
- আইন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দ্বারা অনুমোদিত ও স্বীকৃত। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আইনকে অর্থবহ করে তোলে। অনুমোদন ও স্বীকৃতির অভাবে আইন তার সত্যিকার ও যথাযথ অবয়ব লাভ করতে পারে না।
- আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও অনেক সময় আইনের উপস্থিতি ও আইনের দ্বারা সম্ভাব্য শাস্তির ভয়ে মানুষের মানসিক গতি ও ক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
- সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আইন প্রযোজ্য। এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই আইনের প্রয়োজন সমভাবে অনুভূত হয়।
প্রাচীনকালের আইনগুলো ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই ধর্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ আইন মেনে চলত। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক যুগে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তির ভয়ে আইন মেনে চলে। এছাড়াও অধিকার সংরক্ষণের জন্য, ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সম্প্রীতি বজায় রাখা প্রভৃতি কারণেও মানুষ আইন মেনে চলে।
এ প্রসঙ্গে হৰ্ক্স বলেছেন, 'মানুষ ভালো করেই জানে যে আইন অমান্য করলে সমাজের মধ্যে পুনরায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে, এ সত্য উপলব্ধি থেকেই মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার শিক্ষা নেয়।' জন অস্টিন মনে করেন, 'আইন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও জনসাধারণ কর্তৃক সমর্থিত এবং প্রযুক্ত হয় বলে মানুষ আইন মেনে চলে।
আইনের উৎস: অধ্যাপক হল্যান্ড আইনের ছয়টি উৎসের কথা বলেছেন। যথা- ১. প্রথা; ২. ধর্ম; ৩. বিচারকের রায়; ৪. আইনবিদদের গ্রন্থ; ৫. ন্যায়বোধ: ৬. আইনসভা। উল্লিখিত ছয়টি উৎস ছাড়াও আইনের আরো কতিপয় উৎস রয়েছে। নিচে এগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. প্রথা: সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিকে প্রথা বলা হয়। প্রথা হলো আইনের প্রাচীনতম উৎস। কোনো এক সময়ে কোনো এক ব্যক্তি হয়তো বিশেষ একটি রীতি সমাজে প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যখন সমাজের অনেকেই সেই রীতি অনুসরণ করতে থাকে তখনই তাকে প্রথা বলা হয়।
প্রাচীনকালে পরিবারের সঙ্গে পরিবারের, গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর বিরোধ দেখা দিলে পরিবারপ্রধান বা গোষ্ঠীপতি প্রচলিত প্রথা অনুসারে সেইসব বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন। কালক্রমে সেইসব আচার-আচরণ জনসমর্থন লাভ করলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সেগুলো আইনের মর্যাদা লাভ করে।
উদাহরণ হিসেবে ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি তার সমাজের মূল্যবোধগুলো Coding (কোডিং) করে একটি আইনের বই লিখেছিলেন। আধুনিককালেও প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে প্রথাগত আইনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ায় সেখানে প্রথাগত আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
২. ধর্মীয় বিধিবিধান: ধর্ম আইনের একটি প্রধান উৎস। ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মগ্রন্থ হতে আইনের উৎপত্তি হয়ে থাকে। মধ্যযুগে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা একই হস্তে পরিচালিত ছিল। শাসনকর্তা রাজ্য শাসন করতে গিয়ে ধর্মীয় বিধিবিধান প্রয়োগ করতেন।
বর্তমানেও ধর্মীয় বিধিবিধান থেকে উৎপত্তিগত আইন অনেক দেশে কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনটি ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিধিবিধান থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ফলে এই আইনকে সবাই মেনে চলে ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ থেকে, বাধ্য হয়ে নয়।
৩. বিচারকের রায়: বিচারক অনেক সময় বিচারকালে নতুন নতুন আইন সৃষ্টি করেন। যখন প্রচলিত কোনো আইন দ্বারা কোনো মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না তখন বিচারকদের নতুন আইন তৈরি করে তার নিষ্পত্তি করতে হয়। এভাবে প্রণীত আইনকে 'বিচারক প্রণীত আইন' (Judge made Laws) বা 'বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা' (Judicial Review) বলা হয়।
৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা: প্রখ্যাত আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাও আইনের অন্যতম একটি উৎস। আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা ও আলোচনা অনেক সময় আইনের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে। এ ব্যাখ্যা আদালতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গৃহীত হয়ে থাকে।
মুসলিম আইন গ্রন্থ 'হেদায়া' ও 'আলমগিরি'; ইংল্যান্ডের কোক (Coke) লিখিত ইনস্টিটিউটস, আলবার্ট ভ্যান ডাইসি (Albert Venn Diecy) লিখিত 'ল অব দি কনস্টিটিউশনস' ইত্যাদি গ্রন্থ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
৫. ন্যায়বোধ: ন্যায়বোধ আইনের অপর একটি মূল্যবান উৎস। বিচারকগণ অনেক সময় বিচারকার্য সম্পন্ন করতে গিয়ে সামাজিক ন্যায়বোধ ও বিচার-বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। বিচারকদের ন্যায়বোধ হতে এভাবে নতুন আইন সৃষ্টি হয়।
৬. আইনসভা: আইনসভাকে আইনের আধুনিক উৎস বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রত্যেক দেশের আইনসভা রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার জন্য যাবতীয় আইন প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে অবশ্য জনমতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে স্বীকৃত। আইনসভা প্রণীত আইন সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়।
৭. জনমত: জনমত আইনের উৎসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রেখে প্রণয়ন করা উচিত। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ অপেন হেইমার- এর ভাষায়, 'জনমত আইনের অন্যতম উৎস।
৮. নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রি: আধুনিককালে শাসনব্যবস্থার জটিলতার কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্বের এক বিরাট অংশ শাসনবিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করে। এছাড়া শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে স্বীয় ক্ষমতাবলে প্রয়োজনীয় ঘোষণা ও ডিক্রি জারি করে থাকেন। এরূপ জারিকৃত সকল ঘোষণা বা আদেশকে প্রশাসনিক আইন বলা হয়।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। আইনের ধারণা - Concept of Law এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url