মূল্যবোধের উপাদান বা ভিত্তি (Components of Values)
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে মূল্যবোধের উপাদান বা ভিত্তি (Components of Values) নিয়ে আলোচনা করব।
মূল্যবোধের উপাদান বা ভিত্তি (Components of Values) মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদান বা ভিত্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেসব উপাদান মূল্যবোধের উপাদান বলে বিবেচিত হয়, নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো-
১. নীতি ও নৈতিকতা: নীতি ও নৈতিকতার সাথে মূল্যবোধের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এটি সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। নীতি ও নৈতিকতার অনুমোদন ব্যক্তি তার নিজের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে।
এর মাধ্যমে ব্যক্তি ন্যায়, অন্যায়, উচিত, অনুচিত, ভালো, মন্দ ইত্যাদি পার্থক্য করে নিজের ভালো বা মঙ্গলের চেষ্টা করে। সমাজে কোনো ব্যক্তির ক্ষতি না করা, কারোও মনে কষ্ট না দেওয়া, অহেতুক বিরক্ত না করা, কটূক্তি না করা প্রভৃতি হচ্ছে নীতি ও নৈতিকতা। একজন ব্যক্তির কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় এর পরিমাপক হলো নীতি ও নৈতিকতা।
২. সামাজিক ন্যায়বিচার: সামাজিক ন্যায়বিচার হলো মানুষের অধিকার এবং মানুষের যা প্রাপ্য তা ন্যায়সংগতভাবে প্রদান করা। আইনের চোখে সবাই সমান। সমাজে বসবাসকারী সকলের সুবিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকল কর্মকাণ্ডের মানদণ্ড হবে এক ও অভিন্ন।
সামাজিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মানুষ সুবিচার লাভ করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। সমাজে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হলেই ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সুরক্ষিত হয়।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি সুন্দর, সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যা মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। রাষ্ট্র তথা সরকার যথাযথ আইন মেনে কর্মসূচি গ্রহণ করছে কি না বা এর প্রয়োজনীয়তা নাগরিকদের জানাতে হবে।
আবার, কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলাফল সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে হবে। এতে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। কেননা আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারকে হতে হবে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক।
৪. আইনের শাসন: আইনের শাসন হলো সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। ব্যক্তির স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার রক্ষা, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। ব্রিটিশ জুরিস্ট ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ. ডি. ডাইসির (A.V Dicey) মতে- 'আইনের শাসন হচ্ছে- প্রথমত, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। দ্বিতীয়ত, বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তৃতীয়ত, দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা নাগরিকের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।
জেনে রাখো:স্বচ্ছতা: স্বচ্ছতা হলো এমন একটি বিমূর্ত ধারণা যা দ্বারা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, কোনো কর্মকাণ্ড কতটুকু নীতিসঙ্গত বা বৈধ। এককথায় স্বচ্ছতা হলো সুস্পষ্টতা। এটি সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সরকারি কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর সুশাসন নির্ভর করে। তাই স্বচ্ছতা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সরকার তার কর্মকাণ্ড, নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত জনগণকে অবহিত করবে। জবাবদিহিতা: জবাবদিহিতা হলো সম্পাদিত কর্ম সম্পর্কে একজন ব্যক্তির ব্যাখ্যাদানের বাধ্যবাধকতা। এটি সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুশাসনে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি নাগরিক সেবাদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকেও জবাবদিহিতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে শাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পাৰে, অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত সম্পন্ন হবে এবং দুর্নীতির মাত্রা কমে যাবে।
৫. নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ: নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। সুনাগরিক বলা হয় অধিকার ও কর্তব্য সচেতন নাগরিককে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের অধিকার দান করেছে, তেমনি তাদের নিকট কিছু কিছু কর্তব্যও দাবি করে এবং নাগরিকদের তা পালন করতে হয়।
বস্তুত নাগরিকদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্পাদনের শর্তে অধিকার ভোগ করতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, প্রচলিত আইন মেনে চলা, নিয়মিত কর প্রদান করা, সরকারি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে তা সম্পাদন করা, ভোটাধিকারের সদ্ব্যবহার করা, শিক্ষাদান, অসহায় মানুষের সেবা করা প্রভৃতি হলো নাগরিকের কর্তব্য। সচেতন ও কর্তব্যবোধ সম্পন্ন সুনাগরিক তার অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক এবং কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকে।
৬. শৃঙ্খলাবোধ: শৃঙ্খলাবোধ মানুষের মানবিক মূল্যবোধগুলোকে সুদৃঢ় করে রাষ্ট্র তথা পরিবার ও সমাজজীবনকে উন্নত এবং অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজে শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজ ও ব্যক্তির নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয় এবং সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। তাই রাষ্ট্র তথা সমাজের সর্বস্তরে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
৭. সহনশীলতা: সহনশীলতা শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। সহনশীলতা সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অন্যের মতামত ও মনোভাবকে ধৈর্য ধরে শ্রবণ, শ্রদ্ধা করার মতো সহিষ্ণুতা এবং গুরুত্বের সাথে তা বিবেচনা করা হলো সহনশীলতা। সহনশীলতা উত্তেজনা প্রশমিত করে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনে সাহায্য করে। যে দেশের মানুষ যত সহনশীল সে দেশ তত সুশৃঙ্খল এবং উন্নত।
৮. সহমর্মিতা: 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' অর্থাৎ মানুষ মানুষের জন্য- এ বিষয়টি হলো সামাজিক সহমর্মিতার মূল ভিত্তি। সামাজিক সহমর্মিতা ধারণ করে মানুষ অন্যের সুখ-দুঃখের সাথি হয় ও একে অন্যকে আপন করে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে। সহমর্মিতার অনুভূতি রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
৯. শ্রমের মর্যাদা: সব ধরনের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা করাকে শ্রমের মর্যাদা বলে। এটি একটি মানবিক ও সামাজিক গুণ। একজন দিনমজুর, কৃষক, শিক্ষক, অফিসার, ব্যবসায়ী সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। কেননা শ্রমের মর্যাদা সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে সমাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। মূল্যবোধের উপাদান বা ভিত্তি (Components of Values) এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url