বাংলা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে বাংলা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়ে আলোচনা করব।
গল্পের প্রতি মানুষের চিরকালের আকর্ষণ, তা সে প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাসী মানুষ হোক আর আধুনিককালের কৃতবিদ্য মানুষই হোক। প্রাচীনতম যুগে অরণ্যচারী বর্বর মানুষ সায়াহ্নে যখন আস্তানায় ফিরে আসত তারা তখন নৃত্যগীতে মত্ত হয়ে উঠত। সে গীতের বিষয়বস্তুর মধ্যে হয়তো কোনো শিকারকাহিনি লুকিয়ে থাকত কিংবা কোনো সংঘর্ষ।
সেদিন থেকেই মানুষ নিজের জীবনকে অবলম্বন করে গল্প তৈরি করেছে, তার রসে মুগ্ধ হয়েছে। পরে শিক্ষা, সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের ফলে নানা গল্প-আখ্যান-কোনোটি যুদ্ধবিগ্রহের, কোনোটি প্রেম-প্রণয়ের-ক্রমেই সাহিত্যে স্বীকৃতি লাভ করল। ব্যালাডের আকারে নানা আখ্যান ছন্দে-লয়ে গাওয়া হতো, কখনো বা গদ্যভাষায় বিবৃত হতো।
এভাবে পুরনো সাহিত্যে গদ্য-আখ্যানের উৎপত্তি হলো এবং কালক্রমে সেসব অপরিণত গদ্যকাহিনি সুগঠিত উপন্যাসে রূপ লাভ করল। বাংলা উপন্যাসের উৎপত্তির মূলে আছে ইংরেজি উপন্যাসের প্রভাব। উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে আসার পর এদেশের মানুষের অনুসৃত রীতিনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে আমাদের সাহিত্যে এবং বাংলা উপন্যাসের লক্ষণ ফুটে ওঠার প্রয়াস পায়।
বাংলা উপন্যাস সৃষ্টির আগে নানা ধরনের রূপকথা-উপকথার প্রচলন ছিল। সংস্কৃত রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে দেবদেবীর অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মানবসমাজ ও জীবনের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি, দশকুমার চরিত, কাদম্বরী ইত্যাদির মধ্যেও বিশেষত্ববর্জিত, প্রথাবদ্ধ বর্ণনা বাহুল্যের অন্তরালে উপন্যাসের মৌলিক উপাদান বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
পঞ্চতন্ত্রের গল্প এবং বৌদ্ধ জাতকে বাস্তবতার চিত্র ছিল স্পষ্টতর। এদেশে প্রচলিত রূপকথার উপন্যাসের পূর্বাভাস সহজেই লক্ষ করা যায়। তাছাড়া বাংলা উপন্যাস সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে ঐতিহাসিক কাহিনিকে উপজীব্য করার প্রবণতা দেখা গেছে। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভবের আগের স্তর হিসেবে সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার ব্যঙ্গচিত্রগুলোর কথা উল্লেখযোগ্য।
বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা হলেও তাঁর আগে প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪ ১৮৮৩) 'আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৮) রচনা করে বাংলা উপন্যাসের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। অবশ্য তাঁরও আগে উপন্যাসের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৭৮৭- ১৮৪৮) 'নববাবু বিলাস' (১৮২৫), 'নববিবি বিলাস' (১৮৩০) প্রভৃতি নকশাজাতীয় রচনায়।
'নববাবু বিলাস' গ্রন্থে কলকাতার বাবু সমাজের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজদের অধীনে নানা বৃত্তি ও ব্যবসায়ে প্রভৃত অর্থোপার্জন করে এক নতুন ধনিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। তাদের পোষ্যরা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই অনেক ধনসম্পদের মালিক হয়ে 'বাবু' নামে আখ্যায়িত হয়। এদের চরিত্রে উচ্ছৃঙ্খলতা ও অমিতাচার, খেয়ালিপনা, সৌজন্য ও সুরুচির অভাব ছিল।
এসব নিষ্কর্মা বাবুদের অনৈতিক জীবন গ্লানিকর ব্যাধির মতো সমাজ-কাঠামোকে দূষিত ও দুর্বল করে তুলেছিল। 'প্রমথনাথ শর্মা' ছদ্মনামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রথমবারের মতো এ সামাজিক দোষত্রুটি ব্যঙ্গরস সহযোগে চিত্ররূপ দেন। গ্রন্থটি সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র হলেও উপন্যাসের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নায়ক চরিত্র এতে স্থান পেয়েছে। উপন্যাসের প্রাথমিক ইঙ্গিত সূচিত হয়েছিল এসব গ্রন্থে।
বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের 'আলালের ঘরের দুলাল' বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। নীতিঘেঁষা এ বাস্তব কাহিনিটিতে কুশিক্ষা, সঙ্গ, অভিভাবকের প্রশ্রয় ও অমনোযোগিতায় ধনীর সন্তানের জীবনের দুঃখজনক পরিণাম এবং দুঃখ-দুর্দশা ভোগের পর পুনরায় ভালো মানুষ হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছে।
গ্রন্থের কেন্দ্রীয় চরিত্র ধনীয় আদুরে সন্তান মতিলালের অধঃপতনের কাহিনি বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সে আমলের কলকাতার শিক্ষাদীক্ষা, আচার-অনুষ্ঠানের ব্যঙ্গাত্মক চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। 'আলালের ঘরের দুলাল' সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন,
ক. উপন্যাসোচিত একটি সমস্যার প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া গেল এ রচনায়।
খ. একটি বিস্তৃত দেশজ জীবনপটের, প্রকৃতির এবং মানুষের প্রথম ব্যবহার এখানে পাওয়া গেল। ঔপন্যাসিকের উপযুক্ত সর্বগ্রাহী মনের প্রথম পরিচয় এ রচনায় মিলল।
গ. সর্বোপরি জীবন সম্বন্ধে সুস্পষ্ট একটা মানস সৃষ্টির সাক্ষাৎও প্রথম এ রচনায় লাভ করা গেল।" ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসটির তৎকালীন প্রচেষ্টার নিদর্শনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বলেছেন, "এ শ্রেণির রচনার মধ্যে 'আলালের ঘরের দুলাল'ই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সমধিক উপন্যাসের লক্ষণবিশিষ্ট। এ শ্রেষ্ঠত্ব বাস্তব বর্ণনা, চরিত্র-চিত্রণ ও মননশীলতা-সমস্ত দিকেই পরিস্ফুট।
তাঁর মতে, 'আলালের ঘরের দুলাল'ই সম্ভবত বাংলা ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণাবয়ব সর্বাঙ্গসুন্দর উপন্যাস। অবশ্য শুধু বাস্তব বর্ণনাতেই পর্যবসিত এবং তাতে অন্তর্জগতের গভীরতর সংঘাতের কোনো চিহ্ন না থাকায় 'আলালের ঘরের দুলাল'কে তিনি খুব উচ্চ শ্রেণির উপন্যাসের মধ্যে স্থান দিতে পারেননি।
উপন্যাসে মূল কাহিনি ও প্রধান চরিত্র যেখানে গুরুত্বের সাথে রূপায়িত হওয়ার কথা সেখানে তা হয়েছে নিষ্প্রভ, বরং শাখা কাহিনি ও উপচরিত্র পরিস্ফুটনে লেখক বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে প্যারীচাঁদ মিত্র মানব চরিত্রকে উদার পটভূমিকা থেকে দেখতে চেষ্টা করেননি; বরং নীতিবাগীশ লেখক হিসেবেই বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে বেশি। নীতিকথা প্রচারে সচেতন না হলে ঔপন্যাসিক হিসেবে যথার্থ সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব হতো না।
কালগত দিক থেকে উপন্যাস হিসেবে প্রথম গ্রন্থের দাবি করতে পারেন বিদেশিনী হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স (১৮২৬- ১৮৬১)। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ' (১৮৫২)। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য এ গ্রন্থ রচিত। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় ফুলমণির সুখ আর যথার্থ খ্রিস্টধর্মাচরণ না করায় করুণার দুঃখভোগ, পরে মেম সাহেবের ঈশ্বর প্রেরিত সুপরামর্শে করুণার সুমতি ও সুখের মুখদর্শন এ গ্রন্থের মূল কাহিনি।
লেখিকার একমাত্র লক্ষ্য খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অন্য ধর্মাবলম্বী লোকদের মনে উদ্দীপনা জাগানো। এ প্রসঙ্গে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে লিখেছেন, "১৯৫২ সালে কলিকাতা ক্রিশ্চিয়ান ট্রার অ্যান্ড বুক সোসাইটির উদ্যোগে হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স নামে উক্ত মিশনের এক ক্রিশ্চিয়ান বিদেশিনী উত্তমরূপে বাংলা শিখে দেশি খ্রিষ্টানদের জন্য তাদের সমাজের ঘটনা অবলম্বনে 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ' রচনা করেন।
বিদেশিনীর পক্ষে এ গ্রন্থ রচনা একটি অপূর্ব বিস্ময়। প্যারীচাঁদের সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার কয়েক বছর পূর্বেই ফুলমণির মুদ্রণ সমাপ্ত হয়। দেশীয় খ্রিষ্টান স্কুলে এটি পাঠ্যপুস্তকরূপে প্রচারিত হয়েছিল। এতে যে কাহিনিটি বর্ণিত হয়েছে তাতে খ্রিষ্টান পরিবার সংক্রান্ত ঘটনাই প্রধান, সুতরাং বাঙালি হিন্দু পাঠকসমাজে এর বিশেষ প্রচার হয় নি।
অথচ এর. ভাষায় আশ্চর্য সরলতা ও পরিচ্ছন্নতা লক্ষ করা যায়।" তার তুলনায় কিছু পরে লেখা প্যারীচাঁদের 'আলালের ঘরের দুলাল' সরস কাহিনি সৃষ্টিতে অনেক বেশি সার্থক হতে পেরেছে। 'ফুলমণি ও করুণার বিবরণ'-এ প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনির স্মরণ হলেও তার শিল্পলক্ষণ নামমাত্র, তাই 'আলালের ঘরের দুলাল'ই প্রথম বাংলা উপন্যাসের গৌরব লাভ করেছে।
প্রথম বাংলা সার্থক উপন্যাস সৃষ্টি হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) হাতে। শেক্সপিয়রের নাটকীয় কল্পনা ও স্কটের বর্ণনা নৈপুণ্য- এ দুয়ের সমন্বয়ে তাঁর উপন্যাস অপূর্ব হয়ে উঠেছে। প্লট বা আখ্যায়িকা রচনায়, স্বাতন্ত্র্যবিশিষ্ট চরিত্র সৃষ্টিতে এবং সর্বোপরি বাস্তবের ওপর পরম রমণীয় একটি আদর্শের ছায়া সঞ্চারে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-অতুলনীয়।
কল্পনা ও বাস্তব, ইতিহাস ও রোমান্সের এমন অভিনব সমন্বয় সাধন আজ পর্যন্ত কারও উপন্যাসে সংসাধিত হয়নি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭০), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮৪), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), রাধারণি (১৮৮৬), সীতারাম (১৮৮৭)।
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজে নিযুক্ত থেকে, চাকরির জন্য নানা স্থানে বদলি হয়ে বহু একার সাহিত্য ও সমাজঘটিত ব্যাপারে জড়িত থেকে মাত্র বাইশ বছরের মধ্যে যে এতগুলো বিচিত্র শ্রেণির উপন্যাস লিখেছিলেন এতেই তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা এবং বলিষ্ঠতা প্রমাণিত হয়েছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িকদের মধ্যে তারকানাথ গাঙ্গুলীর সামাজিক উপন্যাস 'স্বর্ণলতা'; রমেশচন্দ্র দত্তের (১৮৪৮ ১৯০৯) 'বঙ্গবিজেতা', 'মাধবী-কঙ্কন', 'রাজপুত-জীবনসন্ধ্যা', 'মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত' প্রভৃতি ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং 'সমাজ' ও 'সংসার' নামক দুখানা সামাজিক উপন্যাস; শিবনাথ শাস্ত্রীর 'মেজ বৌ', 'যুগান্তর'; দামোদর মুখোপাধ্যায়ের (১৮৫৩ ১৯০৭) 'বিমলা'; সঞ্জীবচন্দ্রের (১৮৩৪ – ১৮৮৯) 'জালপ্রতাপ', 'মাধবীলতা' ও যোগেন্দ্র বসুর (১৮৫৫ ১৯০৬) 'মডেল ভগিনী' ও 'শ্রীশ্রী রাজলক্ষ্মী' উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এঁরা সবাই বঙ্কিমচন্দ্রের অসামান্য প্রতিভা দীপ্তির অন্তরালে কোনোমতে আত্মরক্ষা করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র যে আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন তারই ধারা উন্নত, প্রশস্ত ও দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১ ১৯৪১) হাতে। রবীন্দ্রপ্রতিভা যে কত ব্যাপক তা তাঁর গল্প-উপন্যাস আলোচনা করলেই বোঝা যায়। উপন্যাসের স্বাদবৈচিত্র্য, বিষয়বৈচিত্র্য এবং ব্যক্তিবৈচিত্র্য ফোটাতে তিনি যে বিশেষ শিল্পরূপের পরিচয় দিয়েছেন, তার ঐশ্বর্য আজ সর্বজনস্বীকৃত।
রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব বাংলা উপন্যাসের নতুনতর ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর বিবর্তনের সূচনা করে। তিনি মোট ১২টি উপন্যাস রচনা করেন। সেগুলো হলো: বৌ ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯০৯), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৩) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)।
বাংলা সার্থক উপন্যাসের সূত্রপাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইতিহাসের উপকরণের যে সহায়তা অবলম্বন করেছিলেন তা প্রাথমিক অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর খানিকটা প্রভাব বিস্তার করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের যেখানে শেষ হতে যাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের সেখানে শুরু, আর শরৎচন্দ্রের সেখান থেকেই অনুসরণ।
রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হয়- তাকে এককথায় 'রবীন্দ্র যুগ' বলে অভিহিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মত ও পথ অনুসরণে সাহিত্য সৃষ্টি করা এ যুগে তাঁর অনুসারীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ অনুসরণকারীদের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৮৩-১৯৩২) অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে গুরুত্বের অধিকারী। তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম- রমাসুন্দরী (১৯০৮), নবীন সন্ন্যাসী (১৯১২), রত্নদীপ (১৯১৫), জীবনের মূল্য (১৯১৭), সিঁদুর কৌটা (১৯১৯), মনের মানুষ (১৯২২), সত্যবালা (১৯২৫), সতীর পতি (১৯২৮) ইত্যাদি।
বাংলা উপন্যাসের ধারায় মহিলা ঔপন্যাসিকদের আগমন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলা সাহিত্যে মহিলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথমেই স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫ ১৯৩২) উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের এই বড় বোন দীর্ঘকাল বিখ্যাত সাহিত্য মাসিক 'ভারতী'র সম্পাদিকারূপে দায়িত্ব পালনে এবং কবিতা ও নাটক রচনায় খ্যাতিলাভ করলেও গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিভার সার্থক বিকাশ ঘটেছিল।
তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ফুলের মালা (১৮৯৪), মিবার রাজ (১৮৭৭), বিদ্রোহ (১৮৯০), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), কাহাকে (১৮৯৮), বিচিত্র (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১), মিলনরাতি (১৯২৫) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সময় অন্য মহিলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অনুরূপা দেবী (১৮৮১-১৯৫৮), নিরূপমা দেবী (১৮৮৩ ১৯৫১), ইন্দিরা দেবী (১৮৮৯ - ১৯২২) ও সীতা দেবী (১৮৯৫ ১৮৭৭) শক্ত হাতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬- ১৯৩৮) জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন। বাংলা উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ 'চোখের বালি' উপন্যাস, 'নষ্টনীড়' গল্প প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে সমাজচেতনার অভিনব রীতির যে পরিচয় দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তারই বিকাশ ঘটেছে।
মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস সৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় শরৎচন্দ্র তারই অনুসরণ করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই বলা যায়, উপন্যাসের ক্ষেত্রে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করে গতানুগতিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অভিনব পথের পথিকৃৎ হিসেবে শরৎচন্দ্রের বৈশিষ্ট্য রূপায়িত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের অনেক উপন্যাসে নিছক পারিবারিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তাতে কোনো সামাজিক বা নীতিঘটিত প্রশ্ন নেই, কোনো বিরাট আবেগ বা হাহাকার নেই।
বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), পণ্ডিতমশাই (১৯১৭), মেজদিদি (১৯১৫), পল্লীসমাজ (১৯১৬), বৈকুন্ঠের উইল (১৯১৫), অরক্ষণীয়া (১৯১৬), নিষ্কৃতি (১৯১৭) এ সমস্তই বাংলাদেশের পরিচিত ঘটনা। শুধু 'পল্লীসমাজ'-এ সমাজবিরোধী প্রেমের প্রসঙ্গ ও মীমাংসার কথা আছে। এ কাহিনিগুলো অনুত্তেজক পারিবারিক কাহিনি হলেও এর মধ্যে জীবন্ত মানবজীবন আছে।
সহানুভূতি ও বাস্তব ধরনের পটভূমিকার জন্য এর একটি সর্বজনীন আকর্ষণও আছে। বড়দিদি (১৯১৩), বিরাজ বৌ (১৯১৪), শ্রীকান্ত (১ম- ১৯১৭, ২য়- ১৯১৮, ৩য়- ১৯২৭, ৪র্থ- ১৯৩৩), দেবদাস (১৯১৭). চরিত্রহীন (১৯১৭), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), দেনাপাওনা (১৯২৩), শেষপ্রশ্ন (১৯৩১) প্রভৃতি উপন্যাসে শরৎচন্দ্র যেমন খুব জনপ্রিয় কাহিনি ফেঁদেছিলেন, তেমনিই সমাজের তথাকথিত চরিত্রনীতি, সতীত্ব, সংযম প্রভৃতি বাঁধাগথের আদর্শকে উড়িয়ে দিয়ে এ সমাজে অনাচার-অবিচার এবং সেই অবিচারের রথচক্রতলে পিষ্ট মানব-মানবীর মর্মন্তুদ কাহিনি লিখে সমাজের শিষ্ট ও শিক্ষিত স্তরে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছিলেন।
বাংলা উপন্যাসের পরবর্তী ধারা পর্যালোচনায় লক্ষ করা যায় যে, সেখানে উপন্যাসের গতিপথ অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এতদিনকার রীতি-নীতি অনুসরণ না করে অতি আধুনিককালের ঔপন্যাসিকগণ নানাবিধ বৈচিত্র্যের প্রবর্তন করেছেন। শরৎচন্দ্র পর্যন্ত বাংলা উপন্যাস যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল তাঁর অনুসরণে কয়েকজন ঔপন্যাসিক খ্যাতনামা ছিলেন।
কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৩ ১৯৬৪), বেগম রোকেয়া (১৮৮০ ১৯৩২), প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (১৮৯০-১৯৬৪), সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬), চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭ ১৯৩৮) প্রমুখ ঔপন্যাসিক গতানুগতিক ধারার উপন্যাস রচনার বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। আধুনিককালে বাংলা উপন্যাস নানামুখী চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
এ পর্যায়ে বাংলা উপন্যাসের ধারায় যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০ ১৯৩১), কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২- ১৯২৬), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (১৮৯৩ ১৯৬৩), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪ ১৯৫০), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪ – ১৯৭০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮ ১৯৭২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ ১৯৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪- ১৯৮৮), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩ ১৯৭৬), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪ ২০০৬), প্রবোধকুমার সান্ন্যাল (১৯০৫- ১৯৮৩), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮ ১৯৫৬), বনফুল (১৮৯৯ ১৯৭৯), মনোজ বসু (১৯০১ ১৯৮৭), প্রমথনাথ বিশী (১৯০১ ১৯৮৫), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০২ ১৯৭৬), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ ১৯৭৪), আবুল ফজল (১৯০৩ – ১৯৮৩), সত্যেন সেন (১৯০৭ ১৯৮১) উল্লেখযোগ্য।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। বাংলা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url