ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর তাপমাত্রা | ডিম ফোটানোর কৃত্রিম পদ্ধতি (ইনকিউবেটর)
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর তাপমাত্রা | ডিম ফোটানোর কৃত্রিম পদ্ধতি (ইনকিউবেটর) নিয়ে আলোচনা করব।
ডিম ফোটানোর কৃত্রিম পদ্ধতি (ইনকিউবেটর) [Artificial method of Incubation (Incubator)) → মুরগি যেভাবে স্বাভাবিক নিয়মে তাল ও আর্দ্রতা দিয়ে ডিম ফোটায়, ঠিক সেই একই পরিমাণ উত্তাপ ও আর্দ্রতা কৃত্রিমভাবে যন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্টি করে ডিম ফোটানোর পদ্ধতিকে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানো বলে। প্রধানত দুই ধরনের কৃত্রিম।
পদ্ধতির মাধ্যমে ডিম ফোটানো যায়। যথা- তুষ পদ্ধতি ও ইনকিউবেটর পদ্ধতি। একসাথে অনেক ডিম ফোটানোর প্রয়োজন হলে ইনকিউবেটর পদ্ধতি এখন সর্বোত্তম। তবে এর জন্য বিদ্যুৎ থাকা জরুরি। বিদ্যুৎ না থাকলে সেখানে তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানো যায়। হাঁস ও মুরগি উভয়েরই ডিম তুষ পদ্ধতিতে ফোটানো গেলেও সাধারণত হাঁসের ডিম এ পদ্ধতিতে ফোটানো হয়।
তুষ পদ্ধতিতে একবারে ৯৫০টি করে ডিম ফোটানো যায়। তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো- ১. বাঁশের চাটাইয়ের নলাকৃতি কুড়ি, ২. কেরোসিন চুল্লি, ৩. নির্বাচিত পরিষ্কার ডিম, ৪. নলাকৃতি ঝুড়ি বসানোর কক্ষ, ৫. চালনি ও ডালা, ৬. বায়ু চলাচল শূন্য ও তাপ নিরোধক কক্ষ।
ইনকিউবেটর পদ্ধতি:
ডিম ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটর যন্ত্র প্রধানত দুই ধরনের। যথা- (১) কেরোসিন ও (২) বৈদ্যুতিক।
১. কেরোসিন ইনকিউবেটর: কেরোসিনের সাহায্যে চলে। বর্তমানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় না। বিদ্যুৎ যেখানে নেই সেখানে চালানো যেতে পারে।
২. বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর: এটি আধুনিক ও উন্নত যন্ত্র। এ যন্ত্রে একসাথে ২০০০-১০,০০,০০০টি ডিম ফোটানো যায়। বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা আছে এমন স্থানে ইনকিউবেটর রাখতে হবে। ডিম বসানোর আগে যন্ত্র পরিষ্কার করে সঠিকভাবে কাজ করছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। একটি ইনকিউবেটরের কার্যকর প্রধান অংশ ২টি।
যথা- (ক) এগ মেটার ও (খ) হ্যাচারার। ট্রেতে ডিম সাজানোর সময় ডিমের মোটা অংশ উপরের দিকে এবং সরু অংশ নিচের দিকে একটু কাত করে অর্থাৎ ৪৫° কোণ করে রাখতে হয়। ডিম বসানোর ও বাচ্চা ফোটানোর ট্রে কোনো কোনো ইনকিউবেটরে পৃথক পৃথক থাকে।
ডিম ফোটানোর সময় ইনকিউবেটরে যে সমস্ত ব্যবস্থাপনা সতর্কতার সাথে করতে হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো-
ফিউমিগেশন বা ধূমায়িতকরণ: ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর পূর্বেই ধূমায়িত করতে হবে, যাতে ভিতর থেকে কোনো রোগ বাচ্চার সংক্রমণ ঘটাতে না পারে। ধূমায়িত করতে ৪০% ফরমালিন ও পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ধূমায়িত করতে প্রথমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও বিশোধক দ্রব্য দিয়ে ইনকিউবেটর ধুয়ে-মুছে শুকিয়ে নিতে হবে।
তারপর পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও ফরমালিন ব্যবহার করে ধূমায়িতকরণ করতে হবে। ধূমায়িতকরণে যেসব জিনিস প্রয়োজন তা হলো পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ফরমালিন, মাপ সিলিন্ডার, এনামেলের পাত্র। ইনকিউবেটর দুই অবস্থায় ফিউমিগেশন করণ হয়। যেমন- ১. ডিম শূন্য অবস্থায় ও ২. ডিম ভর্তি অবস্থায়।
১. ডিম শূন্য অবস্থায় ইনকিউবেটর ধূমায়িতকরণ: প্রতি ৯.৩ বর্গমিটার জায়গার জন্য ২০ মিলি/গ্রাম পটাসিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট, ৪০ মিলি, ফরমালিন একত্রে মিশিয়ে নিতে হয়। এ রাসায়নিক পদার্থ দুটির আয়তনের অন্তত ১০ গুণ বেশি আয়তনের পাত্রে রাসায়নিক দুটি মিশাতে হয়।
কেননা মিশ্রণ তৈরির সময় প্রচুর ফেনা উৎপন্ন হয়ে পদার্থ উপচে পড়ে যেতে পারে। প্রথমে ইনকিউবেটরের ভিতর পাখার সামনে পাত্রটিকে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেটসহ বসাতে হয়। এরপর পাত্রে ফরমালিন ঢেলে দিয়ে সাথে সাথে ইনকিউবেটরের দরজা বন্ধ করে দিতে হয়। এ অবস্থায় ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত খালি/শূন্য ইনকিউবেটর ধূমায়িত করা হয়।
২. ডিম ভর্তি অবস্থায় ইনকিউবেটর ধূমায়িতকরণ: প্রতি ৯.৩ ব.মি. জায়গার জন্য ১৭.৫ গ্রাম পটাসিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট, ২৫ মিলি, ফরমালিনের সাথে একই নিয়মে মিশিয়ে ডিম ভর্তি অবস্থায় ইনকিউবেটরের ভিতর ১৫-৩০ মিনিট পর্যন্ত ধূমায়িত করা হয়।
ইনকিউবেটর পরীক্ষা করা: ডিম বসানোর আগে ইনকিউবেটর চালু করে এর ভিতরের থার্মোমিটারটি ঠিকমতো কাজ করছে কি-না এবং অন্যান্য সব অংশগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কি-না তা অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
ইনকিউবেটরে ডিম বসানো: ট্রেতে নিয়ম মোতাবেক ডিম সাজিয়ে ইনকিউবেটরের ভিতর বসাতে হয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে প্রথম সপ্তাহে সাধারণত ৩৭.৭৮° সে. তাপমাত্রা রাখতে হয় এবং ডিম ফোটার আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ০.৯° সে. করে তাপমাত্রা কমাতে হয়। ডিম ফোটানোর ইনকিউবেটর প্রস্তুতকারক।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দিয়ে থাকে, বিধায় তা অনুসরণ করা উচিত। অন্যদিকে কেরোসিন ইনকিউবেটরে প্রথম সপ্তাহে ৩৯° সে. তাপমাত্রা রাখতে হয় এবং ডিম ফোটার আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ১.৮° সে. করে তাপমাত্রা কমাতে হয়।
৬. বায়ু চলাচল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: ডিমের ভ্রূণের বেঁচে থাকা, বৃদ্ধি এবং বিপাকের জন্য ইনকিউবেটরের ভিতর বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রয়োজন। তাই ভিতরে বিশুদ্ধ বায়ু চলাচল আবশ্যক। ইনকিউবেটরের ভিতর অক্সিজেনের ঘনত্ব ২১% থাকা এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব ০.৫% এর বেশি হওয়া উচিত নয়। কেননা CO, এর পরিমাণ বাড়লে ডিমের বাচ্চা ফোটার হার কমে যায়।
তাই বায়ু চলাচল যে কক্ষে ভালো সে কক্ষে ইনকিউবেটর রাখা উচিত। প্রত্যেক ইনকিউবেটরে বায়ু চলাচলের জন্য একটি ছিদ্র থাকে। ছিদ্রটি খুলে বা বন্ধ করে বায়ু চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার ৩ দিন পূর্ব হতে বেশি বায়ু চলাচলের প্রয়োজন বলে ছিদ্র খোলা রাখা এবং প্রশস্ত করে দেওয়া উচিত।
আর্দ্রতা: ডিম বসানোর পর হতে ১৮ দিন পর্যন্ত আপেক্ষিক অর্দ্রতা ৫৫%-৬২% এবং শেষ ৩ দিন অর্থাৎ ১৯-২১ দিন ৬৫%-৭৫% রাখা উচিত। আর্দ্রতা কম হলে ডিমের মধ্যে ভ্রূণ শুকিয়ে মারা যায় এবং বাচ্চা ফোটার হার কমে যায়। ছ. ডিম নাড়াচাড়া করানো। ডিমের খোসার সর্বত্র সমভাবে তাপ লেগে যাতে ডিমের ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় সেজনা সঠিকভাবে নিয়মিত ডিম নাড়াচাড়া করা প্রয়োজন।
ডিম বসানোর ৩য় দিন থেকে ১৮ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন। অন্ততপক্ষে ৪ বার ডিম ঘুরানো উচিত। ইনকিউবেটরে টাইমার স্থাপন করা থাকে এবং এটি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ডিম নাড়াচাড়া করে থাকে। কেরোসিন ইনকিউবেটরে ইউ আকৃতির তারের সাহায্যে ডিম নাড়াচাড়া হয়ে থাকে।
ডিম পরীক্ষাকরণ: ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর পর ৭ম দিন প্রথম বার এবং ১৪ তম দিনে ২য় বার ক্যান্ডেলারের। সাহায্যে ডিম পরীক্ষা করা হয়। এতে অনিষিক্ত ডিম ও ডিমের মধ্যে জণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কি-না তা বোঝা যায়। ৭ম দিনে ডিম পরীক্ষার সময় যদি ডিমের মাঝখানে।
বেশি, পার্শ্বে কম মোটা বা প্রথম প্রান্তে (মোটা দিক) বেশি রক্তনালিকা দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে ভ্রূণ। বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি রক্তনালিকা সরু প্রান্তে থিতিয়ে পড়ে থাকে তবে বুঝতে হবে যে ভ্রূণ আর বৃদ্ধি পাবে না বা মরে গেছে। কিন্তু ১৪ তম দিনে ক্যান্ডেলিং করলে জণ মৃত কি-না তা সহজে বোঝা যায়। ক্যান্ডেলিং এর সময় যে ডিমের ভিতর ভ্রূণ জীবিত আছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে সে ডিমটি সম্পূর্ণ কালো দেখা যাবে। ভ্রূণ বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ুকোষ বড় হতে থাকে।
ডিম বসানো ট্রে থেকে হ্যাচিং ট্রেতে ডিম স্থানান্তর: সাধারণত ডিম বসানো বা সেটিং ট্রেতে বসানোর পর থেকে ১৯ তম দিনে হ্যাচিং ট্রেতে স্থানান্তর করা হয়। এ হ্যাচিং ট্রের উপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
ডিম ফোটার সময় যত্ন: ২১ দিন পূর্ণ হওয়ার আগে থেকে ডিমের ভিতর বাচ্চাগুলো নিজেদের ঠোঁট দিয়ে ডিমের খোসা ভেঙে বের হয়ে আসতে প্রস্তুতি নেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়া শেষ না হয় ততক্ষণ ইনকিউবেটরের দরজা বন্ধ রাখা উচিত।
সদ্য ফুটন্ত বাচ্চার যত্ন: সদ্য ফুটন্ত বাচ্চাগুলোর শরীর শুকানোর জন্য খাদ্য ও পানি ছাড়াই ইনকিউবেটরের ভিতর ১৮-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা উচিত। এ অবস্থায় ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা ৩৩.৮° সে.-৩৫° সে. রাখতে হয়। বাচ্চা শুভকরণের পর বাচ্চাগুলোকে ব্রুডার হাউজে স্থানান্তর করা উচিত।
সদ্য ফুটন্ত বাচ্চা বাছাই: ভালো বাচ্চা পাওয়ার জন্য কোষ সম্পন্ন বাচ্চাগুলোকে (পা ছোট/বড়, অন্ধ, দুর্বল, পাখা নেই, ঠোঁট বাঁকা বা ঠিকমতো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত নয়, ভেন্ট বা পায়ুপথ নেই ইত্যাদি) বাছাই করে বাদ দেওয়া আবশ্যক।
কৃত্রিম উপায়ে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের সুবিধা ও অসুবিধা:
সুবিধা:
- একই সময়ে এক সাথে বেশি ডিম ফোটায়ে বাচ্চা উৎপাদন করা যায়।
- বছরের যে কোনো সময় বাচ্চার জন্য ডিম ফোটানো সম্ভব।
- প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর সময় মা মুরগি থেকে বাচ্চার রোগ সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা থাকে না।
- কৃত্রিম পদ্ধতিতে ডিম ফোটাতে মুরগির প্রয়োজন হয় না।
- অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
- বৃহৎ হ্যাচারির জন্য কৃত্রিম পদ্ধতি ছাড়া সহজবোধ্য উপায় নাই।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর তাপমাত্রা | ডিম ফোটানোর কৃত্রিম পদ্ধতি (ইনকিউবেটর) এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url