পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ নিয়ে আলোচনা করব।
পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ (Prawn culture in pond) গলদা চিংড়ি একটি অতি মূল্যবান মৎস্য সম্পদ। মিঠা পানির চিংড়ির মধ্যে গলদা চিংড়ি সর্ববৃহৎ। পুকুর, দিঘি, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি জলাশয়ে এককভাবে বা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রভাবে এর চাষ করা যায়।
পুকুরে গলদা চিংড়ি অত্যন্ত দ্রুত বর্ধিষ্ণু। গলদা চিংড়ি চাষের জন্য পুকুরের গভীরতা ১.০ ১.৫ মিটার হলে উত্তম। পুকুরের আয়তন এক হেক্টর এবং আয়তাকার হলে চিংড়ি চাষে পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা সুবিধাজনক হয়।
যেকোনো আকারের পুকুরে চিংড়ি চাষ করা যায় তবে পুকুরটি খোলামেলা ও পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে এমন স্থানে হতে হবে। পুকুরে পানি সরবরাহ ও নিকাশ সুবিধা থাকতে হবে। পুকুরটি বন্যামুক্ত ও যেকোনো ধরনের দুর্যোগ হতে নিরাপদ হতে হবে।
মাটির গুণাগুণ দোআঁশ, এঁটেল/বেলে দোআঁশ মাটি চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত। মাটির পিএইচ ৫-৬ সবচেয়ে উপযোগী। তবে অম্ল মাটিতে চুন প্রয়োগ করে শোধন করে নিয়ে চিংড়ি চাষ করা যায়। পানির গুণাগুণ: পানির রং সবুজ/হালকা সবুজ/বাদামি সবুজ/হলদে সবুজ হলে চিংড়ি চাষের উপযোগী, যেহেতু এরূপ পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য থাকে।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫.৪ মি. গ্রা./লিটার, পিএইচ মান ৭-৮.৫, স্বচ্ছতা ২৫-৩৫ সেমি, পানির লবণাক্ততা ০-৪ পিপিটি, পানির তাপমাত্রা ১৮-৩৪° সে. হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুর প্রস্তুতি: পুকুরের চার পাড় মজবুত ও তলদেশ অতিরিক্ত কাদাযুক্ত হতে হবে। চিংড়ি খামারের জমির উপরিভাগ সমতল বা একদিকে সামান্য চালু হলে ভালো হয়।
রাক্ষুসে ও অ-চাষযোগ্য মাছ বা অন্য প্রাণী থাকলে পুকুর শুকিয়ে বা সেচে দোষমুক্ত করতে হবে। পুকুর শুকানোর সময় তলায় ৫-১০ সে.মি. ফাটল তৈরি করা ভালো। কিন্তু মাটি এসিড সালফেট যুক্ত হলে না ফাটানো উচিত। মাটির সাথে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার ভালো করে মিশিয়ে দিলে পুকুরে পরজীবী থাকবে না।
আর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে কলিচুন দিতে হবে। এতে মাটি ও পানির অম্লত্ব কমবে, সারের কার্যকারিতা বাড়বে ও পানির ঘোলাতু থাকবে না। চুন প্রয়োগের ১ সপ্তাহ পর সাধারণত সার (জৈব কম্পোস্ট, গোবর, অজৈব ইউরিয়া, টিএসপি) প্রয়োগ করতে হবে। গোবৰ ৩০০ কেজি, ইউরিয়া ২৫ কেজি, টিএসপি ৫ কেজি সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালবেলা পানি মিশিয়ে প্রতি হেক্টর পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের ভাসমান জলজ উদ্ভিদ অপসারণ করতে হবে।
গলদা চিংড়ির পোনা চেনার উপায়। সাধারণত ২-৪ সেমি, আকারের পোনার মাথার ক্যারাপাস নামক আবরণে ২-৫টি কালচে রঙের আড়াআড়ি দাগ থাকে। পোনা একটু বড় হলে দাগ থাকে না। তাছাড়া গলদা চিংড়ির রোস্ট্রাম বাঁকানো এবং উপর নিচে খাঁজ কাটা থাকে। পাগুলো লম্বা এবং ১ম ও ২য় জোড়া পা চিমটাযুক্ত।
পুকুরে পোনা মজুদ। পুকুরে সার দেওয়ার ৩-৫ দিন পর পানির রং হালকা সবুজ হলে এবং পিএইচ নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকলে পোনা ছাড়া যাবে। নার্সারিতে বিশেষত সিমেন্টের ট্যাংকে প্রতিপালিত পোনা ১০-১৫ মি.মি. আকারের হলে পুকুরে মঞ্জুদের উপযুক্ত হয়।
এ পোনা সংগ্রহ করে পুকুরের পানির সাথে তাপমাত্রা ও পরিবেশিক খাপ খাইয়ে সাবধানে পাত্রে স্রোতের সাথে পানি প্রবেশ করিয়ে পুকুরে পোনা ছাড়তে হয়। প্রখর রোদ, বৃষ্টি ও মেঘলা অবস্থায় পুকুরে পোনা মজুদ করা উচিত নয়। গলদা চিংড়ি একক চাষে প্রতি হেক্টরে ১০,০০০ ৫০,০০০ টি পোনা ছাড়া যায়।
গলদা চিংড়ির আশ্রয়স্থল তৈরি: চিংড়ির পোনা খোলস পরিবর্তনের সময় দুর্বল থাকে। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পুকুরে পোনা মজুদের এক দিন আগে খেজুর/নারিকেল, তাল গাছের শুকনো পাতা, পাতা ঝরা বাঁশের কঞ্চি, বাবলা/সেহড়া বা আমের ডালপালা পুকুরের তলদেশে ছড়িয়ে রাখতে হবে।
পোনা মজুদ পরবর্তী অন্যান্য পরিচর্যা। নিয়মিত পানি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পানিতে অক্সিজেনের জন্য এরেটর এবং ভালো ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করতে হবে। শতাংশ প্রতি সারের মাত্রা হলো: গোবর ১৫০-২০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩-৫ গ্রাম, টিএসপি ১-২ গ্রাম, এমওপি ০.৬-১ গ্রাম। সকালে সূর্যের আলো পড়ার পর সার প্রয়োগ করতে হবে।
চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য: চিংড়ি সর্বভুক প্রাণি। গলদা চিংড়ি প্রধানত জলজ পোকামাকড় ও তার ডিম, শূককীট, অ্যালজি, শামুক, ক্রাস্টেসিয়ান, ছোট মাছ, অন্যান্য মৃত প্রাণির অংশবিশেষ ইত্যাদি গ্রহণ করে থাকে। চিংড়ি ক্ষুধার্ত হলে দুর্বল ও ছোট চিংড়িকে খেয়ে ফেলে।
সৌরশক্তি ও প্রয়োজনীয় গ্যাস (কার্বন) পানিতে দ্রবীভূত নানা পদার্থের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উদ্ভিদকণা বা ফাইটোপ্লাঙ্কটন তৈরি করে। উদ্ভিদ কণার জীবনচক্র সমাপ্তির পরই প্রাণিকণার সৃষ্টি হয় এবং এবা খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ কণার উপরই নির্ভরশীল হয়। এক্ষেত্রে প্রাণিকণা বিনাশ প্রক্রিয়ায় দেহের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান পানিতে মিশে যায়।
এভাবে পানির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়, আর এ পরিবেশেই নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদ ও প্রাণি এবং উচ্চশ্রেণির প্রাণিকুল পাশাপাশি অবস্থান করে। এভাবে জলজ পরিবেশে একটি খাদ্যশৃঙ্খলের সৃষ্টি হয়। খাদ্যশৃঙ্খলের পরবর্তী ধাপে পানিতে অবস্থানকারী প্রাণিকণা, নানাধরনের চিংড়ি ও অন্যান্য জলজপ্রাণি খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণরূপে এ প্রাকৃতিক উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক খাদ্য দুই ধরনের। যথা- ১. উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন (Phytoplankton) ও (২) প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন (Zooplankton)
- উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন: গলদা চিংড়ি উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এগুলো হচ্ছে নীলচে সবুজ শেওলা, সবুজ শেওলা, ডায়াটমস, সুতাকার শেওলা ইত্যাদি।
- প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন: চিংড়ি প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এগুলো হলো- কপিপড, ক্লাডোসেরা, রটিফার্স, অস্টাকড, নোনা চিংড়ি জাতীয় (আর্টিমিয়া ও আর্টিমিয়ার লার্ভাবস্থা) প্রাণী।
চিংড়ির সম্পূরক খাদ্য। মাছ ও চিংড়ির অল্প সময়ে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি বাইরে থেকে বাড়তি খাদ্য দেওয়া হয়, যাকে সম্পূরক খাদ্য বলে। আধুনিক পদ্ধতিতে নিবিড় ও অধিক ঘনত্বে চাষ করার জন্য সম্পূরক খাদ্য ছাড়া পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায় না। তবে পুকুরে প্ল্যাঙ্কটন পর্যাপ্ত জন্যালে সার ও খাদ্য দু'টোই সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়। মাছ ও চিংড়ির খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য যে সকল খাবার পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়, তাকে উৎস অনুযায়ী দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ১. উদ্ভিদজাত ও ২. প্রাণিজাত।
- উদ্ভিদজাত: চালের মিহি গুঁড়া, গমের ভুসি, চালের খুদ, আটা, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, ক্ষুদিপানা, কুটিপানা, নরম ঘাস, শাকসবজি ও বীজ, কলার পাতা, পেঁপে পাতা, আলুর পাতা, সজনে পাতা, নেপিয়ার ঘাস ইত্যাদি।
- প্রাণিজাত: ফিসমিল, চিংড়ির গুঁড়া, কাঁকড়ার গুঁড়া, রেশম কীট, শামুকের মাংস, গবাদিপশুর রক্ত, হাঁস-মুরগির নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি। গলদা চিংড়ির পুকুরে পানি ব্যবস্থাপনা: উন্নত পদ্ধতিতে চাষের জন্য পানির গভীরতা ১.২ – ১.৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর প্রতি মাসে ২ বার ৪০ - ৫০% পানি পরিবর্তন করা যেতে পারে। পানির স্বচ্ছতা হবে ২৫ - ৪০ সে.মি. এবং বাঁশ পিটিয়ে বা এরেটর দ্বারা অক্সিজেন যোগ করা ভালো।
চিংড়ি আহরণ: ৬ – ৮ মাস বয়সে চিংড়ি আহরণের উপযুক্ত হয়। তবে জাল টেনে শুধু বড়গুলো আহরণ করা উচিত। এ সময় প্রতিটি চিংড়ি গড়ে প্রায় ১০০ গ্রাম ওজনের হয়। শুধু নীল দাঁড়ার চিংড়ি ধরে নিতে হয় এবং কমলা দাঁড়ার চিংড়িগুলো পুকুরে রেখে দিতে হয়। তবে ৫ – ৬ মাস পরপর জাল টেনে শুধু বড়গুলো ধরে বাজারজাত করা যায়। আবার পানি শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সবগুলোই ধরে নিতে হয়।
চিংড়ির রোগবালাই: চিংড়ি চাষে রোগ প্রতিরোধই উত্তম। দূষিত পরিবেশ, জীবাণুর অনুপ্রবেশ, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত পোনা মজুদ, অক্সিজেনের অভাব, পিএইচ কম বা বেশি, পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পরিমিত খাবার ও তলদেশে কাদা ইত্যাদির কারণে চিংড়ির রোগবালাই হতে পারে। তাই ভালো ব্যবস্থাপনা করা হলে রোগবালাই না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url