পৌরনীতির ক্রমবিকাশ - Evolution of Civics

পৌরনীতির ক্রমবিকাশ - Evolution of Civics

পৌরনীতির ক্রমবিকাশ - Evolution of Civics, পৌরনীতি হলো নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি সামাজিক বিজ্ঞানের একটি অংশমাত্র। পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Civics, যা ল্যাটিন শব্দ Civis ও Civitas থেকে এসেছে। এদের অর্থ যথাক্রমে নাগরিক (Citizen) ও নগরহাট (City State)। প্রাচীন গ্রিসে নাগরিক ও নগররাষ্ট্র ছিল অবিচ্ছেদ্য।

তখন রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবন আবর্তিত হতো। পৌরনীতি বিষয়ের উৎপত্তিগত দিক থেকে দেখা যায়, পৌরনীতি এবং এ সম্পর্কিত অধ্যয়ন প্রাচীন গ্রিসে শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও এর কার্যাবলি সম্পর্কিত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, বিবর্তনের দ্বিতীয় পর্যায়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে গ্রিসে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। এ সময় থেকেই মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা পৌরনীতির যাত্রা শুরু।

পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস প্লেটোর মধ্যে প্রথম সমাজ সম্পর্কে ধারাবাহিক চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যায়। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) তার বিখ্যাত গ্রন্থ "The Republic'-এ নাগরিক, নাগরিকের শ্রেণিবিভাগ এবং সমাজ সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনা করেন। প্লেটোর আলোচনায় পৌরনীতির আভাস লক্ষ করা যায়। পরবর্তীতে প্লেটোর দুযোগ্য ছাত্র এরস্টিটল তার "The Politics' গ্রন্থে বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন।

নাগরিক, রাষ্ট্র ও তার কার্যাবলি সম্পর্কে এত বেশি বাস্তবভিত্তিক আলোচনা এরিস্টটলের পূর্বে আর কেউ করেননি। এ বিবেচনায় এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা পৌরনীতির জনক বলা হয়। তবে প্লেটো ও এরিস্টটল নাগরিক ও রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে চিন্তা করেননি। প্লেটো ও এরিস্টটল পরবর্তী রোমান রাষ্ট্র চিন্তাবিদগণ নাগরিক ও রাষ্ট্রকে দুটি পৃথক বিষয় ও সত্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করে রোমান চিন্তাবিদগণ রাষ্ট্রকে একটি বৈধ প্রতিষ্ঠান ও নাগরিককে বৈধ বলে মত প্রকাশ করেন। তারা আরও বলেন, বৈধ একক হিসেবে নাগরিক কতকগুলো অধিকার ভোগ করবে এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অর্থাৎ নাগরিক, নাগরিক অধিকার এবং রাষ্ট্র এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় রোমান চিন্তাবিদদের হাত ধরে। পলিবিয়াস এবং সিসেরো ছিলেন উল্লেখযোগ্য রোমান চিন্তাবিদ।

গ্রিক এবং রোমান চিন্তাবিদদের পরবর্তী সময়টি হলো মধ্যযুগ। এ সময়টিতে নাগরিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নতি লক্ষ করা যায়নি। মধ্যযুগে রাষ্ট্র নিয়ে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা হয়নি। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মূলত ধর্মাশ্রয়ী ছিলেন। ধর্ম দ্বারা সকল কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। ফলে তখন সৃজনশীল কোনো রাষ্ট্রচিন্তা হয়নি। মধ্যযুগের দার্শনিক ছিলেন সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস একুইনাস, পাদুয়ার মারসিলিও প্রমুখ।

মধ্যযুগের পরিসমাপ্তির পরে ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালিয়ান রাষ্ট্রদার্শনিক নিকোলা ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo Machiavelli) তার 'The Prince' গ্রন্থে বাস্তবভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করার প্রায়াস পান। তিনি 'নগর- রাষ্ট্রের' স্থলে 'জাতীয় রাষ্ট্রের' ধারণা দেন।

তার ধারণার ভিত্তিতেই পরবর্তীতে 'বৃহৎ জাতীয় রাষ্ট্র' গড়ে ওঠে। ১৬৪৮ সালে সম্পাদিত 'ওয়েস্টফেলিয়া' (Westphalia) চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপে নাগরিকতার পূর্বতন ধারণা বিলুপ্ত হয়ে নাগরিকত্বের আধুনিক ধারণা বিকাশ লাভ করে। অন্যদিকে, আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে পৌরনীতি আলাদা বিষয় হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।

আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে সাথে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ের গুরুত্বও বাড়তে থাকে। তবে অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে পৌরনীতির আবির্ভাব খুব বেশি পুরানো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে ১৮৪০ সালের দিকে পৌরনীতি বিষয়টি প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা বিশ্বাস করতেন শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংগঠিত করেই সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

বিশেষ করে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশের সফলতা নির্ভর করে নাগরিকদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধের ওপর। এ জন্য তারা উত্তম নাগরিকতা শিক্ষাদানের জন্য এবং উত্তম নাগরিক গড়ে তোলার জন্য স্কুল কারিকুলামে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়টি যুক্ত করেছিলেন।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ১৯০৪ সাল থেকে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ার স্কুল সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়টি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

0/Post a Comment/Comments