বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশের বিশাল জলরাশীতে চিংড়ি চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত ও মিঠা পানিতে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
চিংড়ি চাষ ও ব্যবস্থাপনা
চিংড়ি চাষ ও ব্যবস্থাপনা (Shrimp culture & management) চিংড়ি কাঁটাবিহীন ও মাংসল জলজ সর্বভুক প্রাণী, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বেড়ি/পোল্ডার বা ঘের পদ্ধতিতে ধানের সাথে বাগদা এবং গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়। বিশ্বে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে স্বাদু পানি, হালকা লবণাক্ত ও সামুদ্রিক লোনা পানিতে প্রায় ৬৭ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। তবে গলদা চিংড়ি স্বাদু পানিতে চাষযোগ্য। যেহেতু মিঠা পানির চিংড়ি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ জলাশয় যেমন- পুকুর, ডোবা, দিঘি, খাল, বিল, নদ-নদীতে এবং লোনা পানির চিংড়ি সাগরের লোনা পানি, ম্যানগ্রোভ এলাকা ও উপকূলীয় জলাশয়ের লবণাক্ত পানিতে পাওয়া যায়।
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন যা বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এটি চিংড়ির একটি প্রাকৃতিক বিরাট আবাসস্থল। বাংলাদেশ থেকে বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪,২৭৮ মে. টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। ১৯৯০-২০০০ পর্যন্ত চিংড়ি খামারের উৎপাদন যেখানে প্রায় ০.২০-০.৬৪ লক্ষ মে. টনে স্থিতিবস্থায় ছিল, সেখানে ২০১৪-১৫ সালে প্রায় ১.৩৫ লক্ষ মে. টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে সব উৎস হতে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৩০ লক্ষ মে. টন।
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা (Prospect of Shrimp Culture in Bangladesh) জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চিংড়ির উৎপাদনে বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি চাষের কাঁচামাল যেমন- চিংড়ির পোনা ও সম্পূরক খাদ্য, লোনা পানি সবই সহজেই পাওয়া যায়। এর বেশির ভাগই প্রাকৃতিক উৎস হতে ব্যবস্থা করা যায়।
বাংলাদেশের নদ-নদী, নদীর মোহনা, উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রের তটরেখা, ম্যানগ্রোভ এলাকা ও সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ মহীসোপান চিংড়ি সম্পদের জন্য একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা। এ বিশাল জলসম্পদ ছাড়াও খাল বিল, হাওর, বাঁওড়, ডোবা, পুকুর, হ্রদ, দিঘিতে চিংড়ি চাষের বিরাট সম্ভাবনা আছে।
চিংড়ি আগে শুধু প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ক্ষেত্রসমূহ হতে আহরণ করা হতো। ক্রমান্বয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে অভিযোজন ও গবেষণার মাধ্যমে স্বাদুপানি, বন্ধপানি, উন্মুক্ত জলাশয়সহ প্রায় সর্বত্রই চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে পেনে বা খাঁচায় পর্যন্ত চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। ধান ক্ষেতেও স্বল্প মেয়াদকালের জন্য চিংড়ি চাষ করা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে গলদা চিংড়ির একক উৎপাদন প্রায় ৪৫০ কেজি/হে। অথচ ধান ক্ষেতে গড় উৎপাদন প্রায় ৩৫০ কেজি/হে। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ২.০০ লক্ষ হেক্টর ধান ক্ষেত চিংড়ি চাষের উপযোগী এবং আরও ৩.০০ লক্ষ হেক্টর জমিতে গলদা চিংড়ি ও মাছ চাষের জন্য ব্যবহার করার সম্ভাবনা আছে।
৯০ এর দশকের অব্যবহিত আগে চিংড়ি চাষের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫,০০০ - ৩০,০০০ হেক্টর, যা ২০০০ সালে প্রায় ১,৪০,০০০ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। পরবর্তী প্রায় দেড় দশক পরে (২০১৪-১৫) চিংড়ি চাষের অধীন খামারি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২,৭৫,৫৮৩ হেক্টর।
দেশে জেলের সংখ্যা প্রায় ১৩.১৬ লাখ (অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ৮.০০ ও সামুদ্রিক জলাশয়ের জেলে ৫.১৬)। সেখানে মৎস্য চাষী ১৩৮.৬৪ লাখ এবং চিংড়ি চাষী ৮.৩৩ লাখ। দেশে ১৭টি সরকারি গলদা হ্যাচারিসহ ৩৬টি হ্যাচারি এবং ৪৯টি বাগদা চিংড়ি হ্যাচারি আছে, যেখান থেকে প্রায় ১২৪৪.০৫ কোটি বাগদার রেণু উৎপাদন (পিএল) হয়।
অপরদিকে সরকারি হ্যাচারি ১৭টিসহ ৩৬টি গলদা চিংড়ি হ্যাচারি, যা থেকে প্রায় ৪.৩০ কোটি পিএল উৎপাদন হয়। প্রাকৃতিক উৎস হতে রেণু সংগ্রহ হয় প্রায় ৪৪১২ কেজি। দেশে বর্তমানে (২০১৪-১৫) ১,৮৯,৯৮০টি চিংড়ির খামার রয়েছে; যেখান থেকে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২,২৩,৫৮২ মে. টন চিংড়ি।
বিশ্বে মোট উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির প্রায় ৬.৩২% এবং গলদা চিংড়ির প্রায় ৫২% বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে। বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারি আছে প্রায় ৮৬৮টি, যেখানে ২০১৫ তে ৫,৩৬,৯৮৩ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানি করে যে পরিমাণ টাকা আয় করে তার একটি তালিকা নিচের ছকে উল্লেখ করা হলো-
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের আওতাভুক্ত এলাকা অনেক এবং প্রতি বছরই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে সর্বত্র চাষ না করার কারণে হেক্টর প্রতি গড় ফলন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশে চিংড়ির গড় উৎপাদন ২০০০ এর দশকে ছিল প্রায় ২৭৩ কেজি/হে; যা ২০১৪-১৫ তে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ কেজি/হে.। অথচ উন্নত দেশে চিংড়ির গড় উৎপাদন ৫,০০০ – ৬,০০০ কেজি/হে.। আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করায় ২০১৫ ১৬ সালে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে ৩৮.৫৫ লাখ মে. টন (মাছ ও চিংড়ি), যা ২০২০ - ২১ সাল নাগাদ ৪১.৩৯ লাখ মে. টনে উন্নীত করা সম্ভব।
তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বর্তমান অবস্থায় ৩.৫১ লাখ মে. টন মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য উদ্বৃত্ত হিসেবে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। এতে স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কর্মের সংস্থান, অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়, পুষ্টি নিরাপত্তা ও রপ্তানি বাণিজ্য শক্তিশালী হবে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url